ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

শান্ত স্বভাবের ফাইয়াজের মুখে-বুকে গুলি

শান্ত স্বভাবের ফাইয়াজের মুখে-বুকে গুলি

ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়ার (ফারহান ফাইয়াজ) কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে খালা নাজিয়া খান। দুইজনের মুখেই হাসি। কিন্তু নাজিয়ার ফেসবুকের এ ছবির ছোট্ট ক্যাপশন বিষাদে ভরা। ছবিটি নিজের আইডিতে পোস্ট করে তিনি লিখেছেন, ‘এটা আমার ফারহান ফাইয়াজ। সে মারা গেছে। আমি বিচার চাই।’

ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী ছিল ফাইয়াজ। ১৮ জুলাই ধানমন্ডিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে সে নিহত হয়। ১৭ বছর বয়সী ফাইয়াজের ২০২৫ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল। ধানমন্ডিতে মা-বাবার সঙ্গে থাকত সে। তাদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার তারাব পৌরসভার বরপা গ্রামে।

সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর খালাতো বোনের ছেলে ফাইয়াজ। নিহতের খবর পেয়ে নিজের সঙ্গে ফাইয়াজের ছবি প্রকাশ করে ফেসবুক পোস্টে গভীর শোক জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। ফাইয়াজের বাবা শহিদুল ইসলাম দিশান প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সে কর্মরত। মা ফারহানা দিবা গৃহিণী। ছোট বোন ফারিন ইসলাম উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী। ফাইয়াজের দাদা, চাচা, চাচাতো-ফুফাতো ভাই- সবাই রূপগঞ্জ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত। শুধু বাবা জাকের পার্টির সদস্য। সামাজিক মাধ্যমে বহু মানুষ ফাইয়াজের মৃত্যুতে শোক জানান। নাজিয়া খানের পোস্ট শেয়ার করে অনেকে শোক জানিয়েছেন। কবি ও ঔপন্যাসিক মুরাদ কিবরিয়া লিখেছেন, ‘তুই না হয় ভাই চলেই গেলি, খোদার নামে; মা কী করে বাঁচবে এখন, ছেলে হারানো জাহান্নামে!’

ফাইয়াজের স্মৃতিচারণ করে বন্ধু ও সহপাঠী নুহান বলেন, ‘আমি কখনও পেছন ফিরে তাকাতে পারব না। তাকালেই দেখব ফাইয়াজ নেই। আমাদের ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। ১৫ তারিখও একসঙ্গে পরীক্ষা দিয়েছি। আমার ঠিক পেছনের বেঞ্চেই ছিল ও। আগামী ২০ তারিখ পরবর্তী পরীক্ষা হবে কিনা জানি না। ওইদিন না হোক, আরেক দিন হবে। হলেই কী? হলে গিয়ে দেখব ফাইয়াজ নাই। আমি কী করে পরীক্ষার হলে বসব?’ ফাইয়াজের মৃত্যুতে নুহানের মতো সহপাঠী শুধু নন, অসংখ্য অভিভাবক, শিক্ষক, সুহৃদরা শোকে হতবিহ্বল। নুহান আরও বলেন, ফাইয়াজ আগে কখনও আন্দোলনে অংশ নেয়নি। জীবনের প্রথম আন্দোলনেই ও ইতিহাসের অংশ হয়ে গেল। বড়দের আন্দোলনে কেন যোগ দিল ফাইয়াজ- এমন প্রশ্নের জবাবে আরেক সহপাঠী খালিদ বলেন, ‘এটা ছাত্রসমাজের আন্দোলন, ন্যায্যতার আন্দোলন। বড় ভাইয়েরা তো সরকারের কাছে অন্যায় কোনো আবদার করেননি। শুধু মেধার ভিত্তিতে চাকরির সুযোগ চেয়েছিলেন। এটা কি অন্যায় চাওয়া? তার বদলে বেদম মারা হলো। অধিকার চাইলে পুলিশ বুকে গুলি চালাবে, এটা কেমন কথা?’ সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওয়াসিফ মুনেম ফাইয়াজের গায়ে গুলি লাগা থেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া কাছ থেকে দেখেছেন। তিনি বলছিলেন, ‘কয়েকদিন ধরে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে পুলিশ ও ছাত্রলীগের ছেলেরা আমাদের বড় ভাইবোনেদের নির্মমভাবে মারছিল, আমরা এটি সহ্য করতে পারিনি। ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়া হলো, গুলি করল। তখন আমরা দেখলাম, কলেজের শিক্ষার্থী ছাড়া এ আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার আর কেউ নেই। এ জন্য ১৮ জুলাই ফাইয়াজসহ আমরা অংশ নিই। আমরা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে আন্দোলন করছিলাম। প্রথমে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল মারছিল। এরপর পুলিশ ধাওয়া দেয়, সঙ্গে মুহুর্মুহু টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। বাঁচতে আমরা ধানমন্ডি-২৭ নম্বরের দিকে ছুটতে থাকি।’ তিনি বলেন, ‘দুপুরের দিকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে কলাবাগান মাঠের দিক যেতে চাইলে সেখানেও পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল মারতে মারতে এগিয়ে আসছিল। আমরা চোখে কিছুই দেখছিলাম না। হঠাৎ শুনতে পাই, ফাইয়াজের বুকে গুলি লেগেছে। একটি মুখে, আরেকটা বুকে লেগেছে। ওর মুখ ও বুক রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে একটি রিকশায় তুলে হাসপাতালের দিকে ছুটছিলাম। একটি অ্যাম্বুলেন্স পেলে তাতে ফাইয়াজকে উঠিয়ে সিটি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাই। পথে দুইবার বড় বড় শ্বাস নিতে দেখেছি। চিকিৎসকরা কিছুক্ষণের মধ্যে আইসিইউতে নেন। এর মধ্যেই আমি আমার বাবা ও ফাইয়াজের বাবাকে ফোন করে বিষয়টি জানাই। ফাইয়াজের বাবা কিছুতেই বিশ্বাস করছিলেন না। তারা হাসপাতালে এলেন, আমাদের বোধশক্তি কাজ করছিল না। আমার বাবা আমাকে নিয়ে বাসায় এলেন। লিফটে ওঠার সময় বাবা আমাকে জানালেন, ফাইয়াজ নেই। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কী দোষ ছিল ওর? আমরা কি অন্যায় কিছু দাবি করেছিলাম?’ জানা যায়, ডিএমপির শীর্ষ পর্যায় থেকে ফাইয়াজের লাশ কলেজে নিতে নিষেধ করা হয়। তবে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ লাশ কলেজ প্রাঙ্গণে আনেন। এ সময় সহস্রাধিক অভিভাবক ও শিক্ষার্থী জড়ো হন। শিক্ষার্থীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। এক পর্যায়ে নসরুল হামিদ অভিভাবক ও ছাত্রদের রোষানলে পড়েন। কলেজ প্রাঙ্গণে থাকা ৫০-৬০ পুলিশ সদস্যকে অভিভাবকরা বের করে দেন। সন্ধ্যার আগে জানাজা শেষে ফাইয়াজের লাশ গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে নেওয়া হয়।

ফাইয়াজের কলেজ শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ওর মতো ছেলে হয় না। অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের, সবাই পছন্দ করত। ফাইয়াজের নিথর দেহ কলেজ প্রাঙ্গণে আনা হলে শত শত অভিভাবক কান্নায় ভেঙে পড়েন। আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। এখনও ওর মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত