১৪৪৬ হিজরি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে চলেছে। বছরের পর বছর এভাবে চলে যাওয়া- নিশ্চয়ই বড় শিক্ষার বিষয়। একটির পর একটি বছর আসা-যাওয়ার মধ্যে রয়েছে উপদেশ ও সতর্কতা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ দিন ও রাতের পরিবর্তন ঘটান, এতে শিক্ষা রয়েছে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের জন্য।’ (সুরা নুর : ৪৪)।
ঈমানদারদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তারা জীবনের সব অবস্থায় চিন্তা-ভাবনা করে। তারা এমন চিন্তা করে যা তাদেরকে আল্লাহর ইবাদত করতে উদ্বুদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন নেক আমল করতে ও গুনাহ থেকে দূরে থাকতে সহায়তা করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলি ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিন ও রাতের পরিবর্তনে নিদর্শনাবলি রয়েছে বোধশক্তিসম্পন্ন লোকের জন্য। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নভোমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে ও বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, তুমি এটা নিরর্থক সৃষ্টি করোনি। তুমি পবিত্র, তুমি আমাদের দোজখের শাস্তি থেকে রক্ষা করো।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৯০-১৯১)।
সহিহ বোখারিতে ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, বিশ্বনবী (সা.) এক রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে সুরা আলে ইমরানের শেষ দশ আয়াত তেলাওয়াত করেন, তারপর অজু করে নামাজ পড়েন। আলেমরা বলেন, ঘুম থেকে জেগে উঠে এই আয়াতগুলো পড়া ও সেগুলোর ওপর গভীর চিন্তা-ভাবনা করা সুন্নত।
প্রিয় মুসলমান ভাইয়েরা, আমাদের উচিত বছরের এই দ্রুত পরিবর্তন থেকে শিক্ষা নেওয়া। সময় কত তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে! আমাদের নিজের আমল ও জীবনের হিসাব এমনভাবে করা উচিত যেন তা আমাদেরকে খাঁটি তওবা করতে ও আন্তরিকভাবে আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে সহায়তা করে- যার মাধ্যমে আমরা তাঁর প্রকৃত বান্দা হতে পারি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামীকালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত।’ (সুরা হাশর, আয়াত : ১৮)।
দিন ও রাতের পরিবর্তন এবং মাস ও বছর পার হয়ে যাওয়া- সেসব লোকের জন্য বড় উপদেশ যারা উপলব্ধি করে, চিন্তা করে ও বুঝতে চায়। এভাবে চিন্তা করলে মানুষ তার মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসায় পূর্ণ হয় এবং প্রকৃতভাবে তাঁর ইবাদতে মন দেয়। মানুষ তখন তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত হয়, যা তাকে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন থেকে রক্ষা করে ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদেশ-নিষেধ মানতে উৎসাহিত করে। সে আল্লাহর শাস্তি ও গজবের কারণগুলো থেকেও সতর্ক থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই দিন ও রাতের পরিবর্তনে এবং আল্লাহ আকাশমণ্ডলি ও পৃথিবীতে যা সৃষ্টি করেছেন তাতে নিদর্শন রয়েছে খোদাভীরু সম্প্রদায়ের জন্য।’ (সুরা ইউনুস : ৬)।
এই দুনিয়াতে একজন মুসলমানের দায়িত্ব হলো, তাঁর প্রভু আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য তাড়াতাড়ি চেষ্টা করা এবং সব রকম গুনাহ ও মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকা। একজন মুসলমানের উচিত, সময় যতই এগিয়ে যাক না কেন, তার রব আল্লাহর নৈকট্য ও ইবাদতে আরও বেশি অগ্রসর হওয়া। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সুখ যেন তাকে চিরস্থায়ী আখেরাত থেকে ব্যস্ত না করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এই পার্থিব জীবন তো অস্থায়ী উপভোগের বস্তু। আর আখেরাতই হচ্ছে চিরস্থায়ী আবাস।’ (সুরা গাফির : ৩৯)। যে ব্যক্তি নিজেকে গুনাহ ও ভুল পথে চলা থেকে বিরত রাখে এবং এমন সব কাজ করে যা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে, সেই সৌভাগ্যবান। যারা সফল হয় তারা গুনাহ থেকে বিরত থাকে এবং আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে নিজেদের পরিশুদ্ধ করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেই সফলকাম হবে, যে নিজেকে পবিত্র করবে। আর সেই ব্যর্থ হবে, যে নিজেকে কলুষাচ্ছন্ন করবে।’ (সুরা শামস : ৯-১০)। তাই হে মুসলিম ভাই, তুমি যেন প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে নেক কাজ ও সৎকর্মে পূর্ণ জীবন গড়ে তোলো। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা পাথেয়ের ব্যবস্থা করো, আর আত্মসংযমই শ্রেষ্ঠ পাথেয়।’ (সুরা বাকারা : ১৯৭)।
আবু বাকরা (রা.) বলেন, ‘কোনো এক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসুল, উত্তম ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, যে দীর্ঘ জীবন পেয়েছে ও তার আমল সুন্দর হয়েছে। সে আবার প্রশ্ন করল, মানুষের মধ্যে কে নিকৃষ্ট? তিনি বললেন, যে দীর্ঘ জীবন পেয়েছে ও তার আমল খারাপ হয়েছে।’ (তিরমিজি : ২৩৩০)।
হে মুসলমানগণ, কোনো ব্যক্তি লাভবান না ক্ষতিগ্রস্ত, সে সফল না বিফল-এর পরিমাপ হচ্ছে তার ঈমান কতটা পূর্ণ, সে আল্লাহর আদেশ কতটা মানে ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণ কতটা করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মহাকালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু এরা নয়, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ (সুরা আসর)
দুঃখজনক লক্ষণ হলো, বছর কেটে যাচ্ছে, অথচ মানুষ নিজের আমলের হিসাব করে না, নিজের অবস্থা নিয়ে চিন্তা করে না। তওবায় দেরি করা কঠিন হৃদয়ের লক্ষণ ও বড় বিপদের কারণ। তাই মুসলমানদের উচিত, আল্লাহর কুদরত দেখানো নিদর্শন ও কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে হৃদয় নরম করা এবং আল্লাহর সঙ্গে নিজের সম্পর্ক ঠিক করে নেওয়া। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা ঈমান আনে তাদের হৃদয় ভক্তি-বিগলিত হওয়ার সময় কি আসেনি, আল্লাহর স্মরণে ও যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে? আর আগে যাদের কিতাব দেওয়া হয়েছিল তাদের মতো যেন এরা না হয়- বহু কাল অতিক্রান্ত হয়ে গেলে যাদের অন্তকরণ কঠিন হয়ে পড়েছিল। এদের অধিকাংশই সত্যত্যাগী।’ (সুরা হাদিদ : ১৬)। আসুন, আমরা নেক কাজে এগিয়ে যাই, ইবাদতে প্রতিযোগিতা করি, গুনাহ ও মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকি এবং আকাশ ও জমিনের প্রতিপালকের শরিয়ত মেনে চলার অঙ্গীকার করি।
(২৪-১২-১৪৪৬ হিজরি মোতাবেক ২০-০৬-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন আবদুল কাইয়ুম শেখ)