ক্রিকেটের অভিজাত সংস্করণে নতুন কিছুর প্রতিশ্রুতি দিয়ে সিলেট টেস্টে জিম্বাবুয়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। কিন্তু প্রত্যাশার বিপরীতে সেই পুরোনো দিনের নাটকই মঞ্চস্থ হয়েছে ২২ গজে। দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়া জিম্বাবুয়ের কাছে বড় ব্যবধানে হারতে হয়েছে স্বাগতিকদের। আরও বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে টাইগারদের সামনে জয়ের বিকল্প নেই। তাই ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে আজ লক্ষ্য নিয়ে চট্টগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ফ্লা. লে. মতিউর রহমান ক্রিকেট স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে সফরকারীদের মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া ম্যাচটি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভি সরাসরি সম্প্রচার করবে।
সিলেটে বাজে ব্যাটিংয়ের মাশুল দিয়ে বিব্রতকর পরাজয়ের পর চট্টগ্রামে দুদিন অনুশীলনের সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ। শনিবার পুরো দল মাঠে এলেও, ম্যাচের আগের দিন বিশ্রামে থাকেন তিন পেসার হাসান মাহমুদ, সৈয়দ খালেদ আহমেদ ও তানজিম হাসান।
বোলিং নিয়ে তেমন দুর্ভাবনার কারণও নেই বাংলাদেশের। গত কয়েক ম্যাচ ধরেই ব্যাটিংয়ের কারণে ভুগছে তারা। উদ্বোধনী জুটিতে নেই রানের দেখা।
মুমিনুল হক ও নাজমুল হোসেন শান্ত পারেননি ইনিংস বড় করতে। দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিমের ব্যাট থেকে হাসি উধাও অনেক দিন ধরেই। টানা ১২ ইনিংস ধরে ৪০ ছুঁতে না পারা মুশফিককে বরাবরের মতো রোববারও দেখা গেছে বাড়তি অনুশীলন করতে। স্বীকৃত ব্যাটসম্যানদের নেট সেশনের সময় শেষ হওয়ায় একপর্যায়ে ৩৯ ছুঁইছুঁই ব্যাটসম্যানকে বেরিয়ে আসতে বলেন সিনিয়র সহকারী কোচ। রানে ফেরার তাড়না থেকেই হয়তো কোচের কাছ থেকে আরও সময় চেয়ে নেন মুশফিক। পরে নাঈম হাসান, তাইজুল ইসলামের মতো লেজের সারির ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে অনুশীলন করেন তিনি। রোববার সাগরিকায় দুই ঘণ্টার অনুশীলন পর্ব শেষ করে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ কোচ ফিল সিমন্স বলেন, ‘আমরা আশা করি, চার দিনেই ম্যাচটি জিতে যাব।’
সন্দেহ নেই, জয়ের জন্যই নামবে বাংলাদেশ। প্রায় ২১ বছর পর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ হার এড়াতে এর কোনো বিকল্পও নেই স্বাগতিকদের। তবে প্রথম ম্যাচের বদলা নিয়ে চার দিনেই ম্যাচ জিততে ব্যাটে-বলে প্রয়োজন দাপুটে পারফরম্যান্স। এজন্য মাঠে দেখাতে হবে ইতিবাচক মানসিকতা। সংবাদ সম্মেলনে সে বার্তাই দিলেন সিমন্স। ‘আমরা জানি, প্রথম ম্যাচে দল হিসেবে ভালো ব্যাটিং করতে পারিনি এবং নিজেদের সমস্যায় ফেলেছি। এখন আমাদের ভাবনা হলো, ইতিবাচক ব্র্যান্ডের টেস্ট ক্রিকেট খেলতে চাই। এমন না যে, সারা দিন ব্যাটিং করে ২০০ রান করব।’ ইতিবাচক ক্রিকেট খেলার জন্য ব্যাটসম্যানদের সহায়ক হতে পারে চট্টগ্রামের উইকেট। বরাবরই রানপ্রসবা এই ভেন্যু। যদিও গত অক্টোবরে খেলা সবশেষ টেস্টে একবারও দুইশ ছুঁতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে ওই ম্যাচেই প্রথম ইনিংসে ৫৭৫ রান করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
এছাড়া চট্টগ্রামের মাঠে বাংলাদেশেরও রয়েছে বড় রান করার অভিজ্ঞতা। রোববার সকালে অধিনায়ক শান্তর সঙ্গে মিলে উইকেট দেখার পর সিমন্সেরও ভাবনা, ব্যাটিংয়ের জন্য ভালো উইকেটই পাবেন তারা। ‘উইকেট খুবই ভালো মনে হচ্ছে। বেশ শক্ত, মসৃণ এবং কিছুটা শুষ্ক। ম্যাচের পরের দিকে কিছুটা টার্ন আশা করতে পারি, যা আমাদের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে।’
ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে আসার আগে উইকেট দেখার সুযোগ পাননি জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক ক্রেইগ আরভাইন। তবে অনুশীলন উইকেট দেখে তার ধারণা, স্পিনের বড় প্রভাব দেখা যেতে পারে চট্টগ্রাম টেস্টে। ‘নেটের উইকেটগুলো আমাদের কাছ কিছুটা মন্থর মনে হয়েছে। খেলা যত এগোবে, হয়তো স্পিন বেশ বড় ভূমিকা রাখবে এই টেস্টে।’ উইকেট-কন্ডিশনের সুবিধায় ব্যাটিংয়ে ভালো করার রসদ পেলেও, পেস বিভাগে কিছুটা শক্তি হারিয়েছে বাংলাদেশ। পাকিস্তান সুপার লিগ খেলতে গেছেন নাহিদ রানা। তার জায়গায় নেওয়া হয়নি আর কোনো পেসার।
সিমন্সের বিশ্বাস, হাসান মাহমুদ, সৈয়দ খালেদ আহমেদরা নিজেদের স্কিল দিয়ে নাহিদের গতির অভাব পুষিয়ে দিতে পারবেন। ‘আমার মনে হয় না শক্তি কমেছে। আমরা গতি হারিয়েছি। নাহিদ রানার মতো গতিময় আর কেউ নেই। তবে স্কিল আছে, বিশেষ করে চট্টগ্রামে বোলিংয়ের কৌশল তারা জানে। এটি সবসময়ই মন্থর উইকেট। আশা করি, আমরা টার্ন আদায় করে নেব এবং পেসাররা স্কিল দিয়ে নিজেদের কাজটা করবে।’
মাঠের ক্রিকেটে নিজেদের প্রস্তুতি যথাযথ সেরে পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলা বাংলাদেশ দলের প্রতিপক্ষ শুধু জিম্বাবুয়েই নয়।
নাজমুল হোসেন শান্তর দলকে লড়তে হবে দেশের ক্রিকেটের চলমান বাস্তবতার সঙ্গেও। প্রিমিয়ার লিগে গত ১২ এপ্রিল আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে দুই ম্যাচ নিষিদ্ধ হন হৃদয়। ওই ম্যাচ খেলেই টেস্ট যোগ দেন ক্রিকেটাররা। পরে হৃদয়ের সেই শাস্তি কমানো, শাস্তি পুনর্বহাল, ক্রিকেটার একজোট হয়ে বোর্ডে নিজেদের অবস্থান জানানো, হৃদয়ের নতুন করে শাস্তি এবং নানা পক্ষের মধ্যে টানাপোড়েনসহ নানান ঘটনায় মাঠের বাইরের ঘটনাই এখন মূল আলোচনায়। যদিও শুরু থেকেই ঢাকার বাইরে টেস্ট দলের ক্রিকেটাররা। কিন্তু ইন্টারনেট ও সামাজিকমাধ্যমের যুগে ভৌগোলিক দূরত্ব তেমন কিছুই নয়।
মাঠের বাইরের উত্তাল পরিস্থিতি যে টেস্ট ক্রিকেটারদেরও ছুঁয়ে যেতে পারে, সেই ব্যাপারে সতর্ক সিমন্স। ম্যাচ শুরুর আগে তাই শান্ত, মুমিনুলদের আগলে রাখার দিকে বাড়তি মনোযোগ দিতে চান তিনি। ‘এই ব্যাপারটি কোচিং স্টাফ হিসেবে আমাদের নিশ্চিত করার চেষ্টা করতে হবে যে, ওরা যেন এসব থেকে দূরে থাকে, মনোযোগে যেন ব্যাঘাত না ঘটে, বাইরের এসব আলোচনার কথা আপনি বলছেন। আমরা একটি টেস্ট ম্যাচ খেলতে যাচ্ছি। আগামীকালের আগে আজকে সন্ধ্যায় আমাদের চূড়ান্ত মিটিং যখন হবে, তখন এই ব্যাপারটিতে গুরুত্ব দিতে হবে যেন ওদের মনোযোগে ব্যাঘাত না ঘটে। এটা আগামী পাঁচদিনের ব্যাপার, এই পাঁচদিনে শুধু বাংলাদেশ ক্রিকেটই ভাবতে হবে, বাইরের কোনো কিছু নয়।’
মাঠের ক্রিকেটে মনোযোগ ফিরিয়ে চট্টগ্রাম টেস্টের সম্ভাব্য কম্বিনেশন খোলাসা করেননি সিমন্স। একই পথে আরভাইনো। শেষ সময় পর্যন্ত উইকেট-কন্ডিশন পর্যবেক্ষণ করে একাদশ চূড়ান্ত করা হবে বলেন জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক। তাদের পরিস্থিতি অবশ্য বাংলাদেশের ঠিক বিপরীত। প্রায় চার বছর পর টেস্ট জেতার পর এখন সিরিজ জেতার হাতছানি। ২০০১ সালের পর আর দেশের বাইরে সিরিজ জেতেনি তারা। আর বাংলাদেশের বিপক্ষে তাদের সবশেষ সিরিজ জয় ২০০৪ সালে। দীর্ঘ অপেক্ষা ঘোচানোর সম্ভাবনাকে বাড়তি চাপ হিসেবে নিতে চান না আরভাইন। ‘প্রথম ম্যাচটি জেতার প্রক্রিয়াটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। এমন না যে, ১-০তে এগিয়ে থাকায় আমরা নিজেদের ওপর চাপ নিয়ে নেব। অবশ্যই সিরিজ জয়ের একটা প্রত্যাশা থাকবে। ছোট ছোট ধাপে ভাগ করতে হবে এবং প্রক্রিয়া ঠিক রাখতে হবে। যত লম্বা সময় এটি করতে পারব, তত আমাদের সুযোগ পারবে। এখনই ম্যাচের ফল নিয়ে ভাবলে হবে না।’
বাংলাদেশের অবশ্য ফল নিয়ে না ভেবে উপায় নেই। কারণ গত বছর ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে তারা। এবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও সিলেটে হেরে নতুন তলানিতে পৌঁছে গেছে দেশের ক্রিকেট। এখন যদি সিরিজ হার এড়ানো না যায়, তাহলে হয়তো মাটি খুঁড়ে মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজতে হবে!