হত্যা, শেয়ার জালিয়াতি এবং প্রতারণার একাধিক মামলা ধামাচাপা দিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ১০০ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন ট্রান্সকম গ্রুপের সিইও সিমিন রহমান। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এর যৌথ তদন্তে উঠে এসেছে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য।
তদন্ত অনুযায়ী, সিমিন রহমান মামলার গতি পরিবর্তন করতে তিন দফা গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অভিযোগ রয়েছে, এই উৎকোচ দেওয়ার পর তাকে হত্যা ও শেয়ার প্রতারণা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়নি এবং সংশ্লিষ্ট মামলাগুলোর তদন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গণভবনে সিমিন রহমান শেখ হাসিনাকে শেখ মুজিব জাদুঘর ট্রাস্টের জন্য ৫০ কোটি, সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের উন্নয়ন সংস্থা সূচনা ফাউন্ডেশনের জন্য ২৫ কোটি এবং নগদ ২৫ কোটি টাকা প্রদান করেছিলেন। এই চেক প্রদানের সময় বিতর্কিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলম (এস আলম) এবং একাত্তর টেলিভিশনের তৎকালীন সিইও মোজাম্মেল বাবু উপস্থিত ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে সূচনা ফাউন্ডেশনের দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে গিয়ে এ চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
সূচনা ফাউন্ডেশনের অ্যাকাউন্ট নিরীক্ষা করে সেখানে সিমিন রহমানের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ২৫ কোটি টাকার চেক নগদায়নের তথ্য পাওয়া গেছে। ২০২৪ সালের ১৮ মার্চ তারিখের চেকটি ২৭ মার্চ সূচনা ফাউন্ডেশনের অ্যাকাউন্টে নগদায়ন হয়। এ ছাড়া শেখ মুজিব ট্রাস্টেও একই সময় জমা হয় ৫০ কোটি টাকা। বাকি ২৫ কোটি টাকা নগদে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
২০২৩ সালের ১৬ জুন ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা লতিফুর রহমানের বড় ছেলে আরশাদ ওয়ালিউর রহমান রহস্যজনকভাবে মারা যান। অভিযোগ রয়েছে, তার মৃত্যুকে স্বাভাবিক দেখানোর জন্য ইউনাইটেড হাসপাতালের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয় এবং মৃত্যুর সনদপত্র জালিয়াতি করা হয়। এ ঘটনায় ছোট বোন শাযরেহ হক দাবি করেন, পৈতৃক সম্পত্তি আত্মসাতের জন্যই সিমিন রহমান তার ভাইকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছেন।
২০২৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শাযরেহ হক গুলশান থানায় সিমিন রহমান এবং তার মা শাহনাজ রহমানের বিরুদ্ধে শেয়ার জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের মামলা করেন। মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। পিবিআইয়ের তদন্তের ভিত্তিতে ট্রান্সকম গ্রুপের পাঁচ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হলেও, সিমিন রহমান বিদেশে অবস্থান করায় তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। দেশে ফিরে জামিন পাওয়ার পর তিনি দ্রুত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মামলাগুলো ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালান।
এরপর ২২ মার্চ শাযরেহ হক তার ভাইকে হত্যার অভিযোগে গুলশান থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করেন, যেখানে প্রধান আসামি করা হয় সিমিন রহমানকে। তবে মামলাটির তদন্ত হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায়।
তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, ২০২৪ সালের ১৫ মার্চ, ১৮ মার্চ ও ১৫ জুন—এই তিন দফা গণভবনে গিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন সিমিন রহমান। দ্বিতীয় বৈঠকে তিনি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের দুটি চেক হস্তান্তর করেন।
গণভবনের এন্ট্রি লগে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় সিমিন রহমান, এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মো. সাইফুল আলম এবং একাত্তর টেলিভিশনের সিইও মোজাম্মেল বাবু একসঙ্গে গণভবনে প্রবেশ করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়াও এসব বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
দ্বিতীয় বৈঠকের সময় সিমিন রহমান প্রথম আলো বিক্রির ব্যাপারে শেখ হাসিনার সঙ্গে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীতে, শেখ হাসিনার অনুমোদন নিয়ে প্রথম আলো এস আলম গ্রুপের কাছে বিক্রি করা হয়।
২০২৫ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর বিভিন্ন নথিপত্র প্রকাশ্যে আসে, যেখানে শেখ হাসিনার সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তির বৈঠকের তথ্য পাওয়া যায়। নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরও এখনো এই মামলাগুলোর তদন্তে কোনো অগ্রগতি হয়নি। শাযরেহ হক অভিযোগ করেছেন, নতুন সরকারেও সংশ্লিষ্টরা প্রভাব খাটিয়ে মামলাগুলো ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। তিনি ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছেন।