
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ফেনী জেলা শাখার তিন মাসের জন্য গঠিত আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে ছয় বছর চলার পরও সম্মেলন কিংবা নতুন কমিটি গঠনের কার্যকর কোনো অগ্রগতি নেই। এতে করে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে চরম হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে, দলীয় শৃঙ্খলার বেঘাত গড়ার পাশাপাশি পাড়া-মহল্লায় গড়ে উঠছে সুবিধাভোগী পাতি নেতা। জেলা নেতারা কৃষি জমির উর্বর মাটি কাটা, বালু উত্তোলন ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ড বন্ধে বৈঠক করে কঠোর হুঁশিয়ারি দিলেও তৃণমূলে এর তেমন প্রভাব পড়েনি। এসব সুবিধাভোগী নেতাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বিব্রত হচ্ছে জেলার নেতারাও। এরইমধ্যে বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বহিষ্কার, পদ স্থগিত, কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার পাশাপাশি ফেনী সদর উপজেলার মোটবী ও ফরহাদনগরের ঘটনা তদন্তে গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। তৃণমূল নেতাকর্মীদের দাবি আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড শক্তিশালী করতে এবং দলীয় শৃঙ্খলা ফেরাতে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করে নতুন জেলা কমিটি ঘোষণার।
২০২৪ এর ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ফেনীতে বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতি ফিরার কথা থাকলেও কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তহীনতার কারণে ৯০ দিনের আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে ৬ বছর পার করেছে দলটির ফেনী জেলা শাখা। এরইমধ্যে জেলা বিএনপির একজন যুগ্ম আহ্বায়কসহ বেশ কয়েকজন সদস্য মৃত্যুবরণ করেছে। বিএনপির হাইকমান্ডের নির্দেশে দুঃসময়ে যারা দলের হাল ধরেছিলেন এমন ত্যাগী নেতাদের দিয়ে কমিটি ঢেলে সাজানোর কয়েক দফা উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়। বর্তমানে তৃনমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলের মামলা-হামলার শিকার, ত্যাগী-নির্যাতিতদের সমন্বয়ে ক্লিন ইমেজধারীদের মূল্যায়ণ করে ফেনী জেলা বিএনপির কমিটি গঠন করার। তবে সেই দিন কবে আসবে কেউ জানে না।
জানা গেছে, ফেনী জেলা বিএনপির মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে দীর্ঘ ১০ বছর পর ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর ৪৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটিতে জেলা বিএনপির সাবেক প্রচার সম্পাদক শেখ ফরিদ বাহারকে আহ্বায়ক ও তৎকালীন ফেনী পৌর বিএনপির সভাপতি আলাল উদ্দিন আলালকে সদস্য সচিব করা হয়। দলটির তৎকালীন কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক বেলাল আহমেদ স্বাক্ষরিত প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে নতুন আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়। কমিটিতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সম্মানিত সদস্য ও এমএ খালেক, গাজী হাবিব উল্যাহ মানিক, আলা উদ্দিন গঠন (বর্তমানে প্রয়াত), এয়াকুব নবী ও আনোয়ার হোসেন পাটোয়ারীকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করা হয়। একইসঙ্গে ফেনী সদর উপজেলা ও ফেনী পৌরসভা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিও গঠন করা হয়। পরে জেলা কমিটির নেতারা পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলা আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিগত ১৬ বছরে দমন নিপীড়নের কারণে সারা দেশের মতো ফেনীতে প্রভাব পড়ে বিএনপি ও এর সহযোগী অঙ্গ সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক কার্যক্রমে। আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে এবং পরিবেশ অনুকূল না থাকায় কোথাও সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি। বিগত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর ফিরতে শুরু করে সাংগঠনিক গতি। এরইমধ্যে কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে শক্তিমত্তা জানান দিয়েছে দলটি। গত ১৬ বছর নানামুখী চাপে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ঢিলেঢালা চললেও এখন বিভিন্ন কর্মসূচিতে রেকর্ড সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
বিগত আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিয়ে মামলা-হামলার শিকার বেশ কয়েকজন নেতা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, বর্তমান আহ্বায়ক কমিটি দল গোচানোর পরিবর্তে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত হয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাঝেও বিভাজন সৃষ্টি করছে, যা দলের জন্য ক্ষতিকর।
তাই নবীন-প্রবীন নেতাদের সমন্বয়ে দলের দুঃসময়ের ত্যাগী-নিবেদিত ও ক্লিন ইমেজধারীদের মূল্যায়ন করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হোক।
ফেনী সদর উপজেলা যুবদলের এক যুগ্ম আহ্বায়ক জানান, স্বৈরাচার সরকারের আন্দোলন চলাকালীন হাতে গনা কয়েকজন ত্যাগী-নির্যাতিত নেতাকর্মী ছাড়া আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে থাকতো না। বেশির ভাগ কর্মসূচি ভিতরের বাজারের ইসলামপুর রোডে পালন করত! ছাত্র-জনতার রক্তপাতের মাধ্যমে স্বৈরাচার খুনি হাসিনাকে বিদায় করেছি, এখন আমরা ত্যাগি নির্যাতিত কর্মীরা চাই আহবায়ক কমিটি ভেঙে দিয়ে জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিলে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ভিতরে আস্থা ফিরে আসবে এবং জিমিয়ে পড়া কর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে মাঠে কাজ করবে কর্মীরা। ফেনী জেলা বিএনপির অন্যতম যুগ্ম আহ্বায়ক গাজী হাবিব উল্যাহ মানিক জেলা বিএনপির কমিটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে তিনি বলেন ‘২০১৯ সালের এই দিনে ফেনী জেলা বিএনপির তিন মাসের মেয়াদে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষিত হয়। আজ অবধি ছয় বছরে একটা উপজেলা কমিটি ও পৌর কমিটির সম্মেলন হয়নি। মনে প্রশ্ন জাগে এ দল কিভাবে চলছে?’ তার এ স্ট্যাটাসে নানাজন নানান মন্তব্য করেন।
বিএনপি হাইকমান্ড আগামী তিন মাসের মধ্যে সম্মেলনের মাধ্যমে ইউনিয়ন, পৌর, উপজেলা, থানা ও জেলা কমিটি সম্পন্ন করে কমিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর থেকে নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা জল্পনা কল্পনা দেখা দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন আওয়ামী লীগ সরকার আমলের ত্যাগী ও নির্যাতিতদের সমন্বয়ে কমিটি করা না হলে সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতিশীলতা ফিরে আসবে না। তবে তৃনমূল পর্যায়ের বিভিন্ন স্থানে কমিটি না থাকায় সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি করার বিষয়ে জটিলতা দেখা দিলেও অনেকেই হাইকমান্ডের নির্দেশনার আলোকে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি তৈরি করছেন বলে জানা গেছে ।
গিয়াস উদ্দিন নামে এক বিএনপি কর্মী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, বিগত ১৬ বছর আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে বেশ কয়েকবার হামলার ও ১০টি মিথ্যা মামলার আসামি হয়েছি। এখন পযর্ন্ত কোনো মূল্যয়ন পাইনি। ফ্যাসিস্টমুক্ত পরিবেশে বিএনপির জন্য কিছুটা সুসময় এসেছে এখনও যদি ত্যাগীদের সঠিক মূল্যয়ন না হয়, হতাশ হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। ফেনী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ফরিদ বাহার জানান, কেন্দ্র থেকে ভোটের আগ পর্যন্ত মূল কমিটি গ্রহণ করার তেমন কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
ফেনী জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আলাল উদ্দিন আলাল বলেন, বিগত সময়ে ফেনী একটি যুদ্ধ ময়দানের পরিবেশ ছিল। ফুলগাজীতে কর্মসূচি পালন করতে গেলে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়। এছাড়া আমরা কোথাও গিয়ে সম্মেলন করার পরিবেশ ছিল না। ইউনিয়ন কিংবা উপজেলা কমিটি গঠনে বৈঠক করে দফায় দফায় হামলার শিকার হয়েছি। বর্তমানে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি।