ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ডাকবাক্সে আগের মতো চিঠি আসে না

ডাকবাক্সে আগের মতো চিঠি আসে না

ডাকপিয়ন রফিক মিয়ার আফসোস আগের মতো এখন আর কেউ চিঠি লেখে না। তাই ভালোবেসে কেউ এখন রফিক চাচা বলেও ডাকে না। রফিক মিয়া প্রায় ৩০ বছর থেকে ডাক পিয়নের কাজ করছেন। ছেলে, মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে সুখের সংসার। রফিক মিয়া আগে ভোর হলেই হেঁটে বের হতেন ডাক (চিঠিপত্র) বিলির কাজে। কিন্তু কালের বির্বতনে আর প্রযুক্তির যুগে হারিয়ে যেতে বসেছে ডাকবাক্স। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে ডাকবাক্স এখন ইনবক্সে পরিণত হয়েছে।

এক সময় জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন স্থানে যত্রতত্র দেয়ালে, গাছে, স্টেশনে, প্ল্যাটফর্মে ডাক বাক্স চোখে পড়ত। দিনে একবার ডাক বাক্স খুলে ডাক বিভাগের লোকজন চিঠিপত্র সংগ্রহ করে নিত। কিন্তু এখন আর শহর বা গ্রামে সেসব ডাকবাক্স তেমন একটা চোখে পড়ে না। এরও আগে যখন ডাকেরই প্রচলন হয়নি, তখন পোষা পায়রার পায়ে বেঁধে প্রিয়জনের কাছে বার্তা পাঠাতো মানুষ। এরপর এলো ডাকযুগ। প্রিয়জনের চিঠি পাবার আশায় ডাকপিয়নের পথ চেয়ে থাকার দিন হলো শুরু। সেই যুগ আর নেই।

মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে ই-মেইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইমো, ভাইবারসহ কত যোগাযোগ প্রযুক্তির সুবিধা আজ সবার হাতে। এখনকার সময়ে শহরের চেয়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই গ্রাম। গ্রামের মানুষের কাছেও এখন এসব সুবিধা পৌঁছে গেছে। যখন ইচ্ছে প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগটা তারাও নিচ্ছে। বার্তা আদান প্রদানে চিঠির বদলে সবার ভরসা এখন নতুন নতুন প্রযুক্তিতে। এরই ধারাবাহিকতায় ডাক বিভাগ বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে চুয়াডাঙ্গাসহ সারা দেশে। গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ ডাকঘর দিনের পর দিন বন্ধ থাকছে।

অধিকাংশ ডাকঘরে নেই কোনো ডাকবাক্স। দু-একটি থাকলেও তারমধ্যে চিঠির পরিবর্তে থাকছে ময়লা আবর্জনা। জেলা এবং উপজেলা ডাকঘর ছাড়া সব কটিতেই এই নাজুক অবস্থা। ডাক বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অভিমত, প্রযুক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে ডাক বিভাগ। এখন কেউ চিঠির খোঁজ নিতে আসে না। তাই কর্মীদেরও চিঠি পৌঁছে দেওয়ার নেই কোনো তাগিদ। অলস সময় কাটে সবার। অথচ এককালে ডাক বিভাগ ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। চিঠি, পণ্য পার্সেল, টাকা পরিবহনে একমাত্র ভরসা ছিলো ডাক বিভাগ।

ষাটের দশকে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ আওতাবহির্ভূত এলাকার পোস্ট অফিসে ছিল টেলিগ্রাম ব্যবস্থাও। কিন্তু প্রযুক্তির অতল গর্ভে হারিয়ে গেছে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা। এখন আর কেউ টেলিগ্রাফের ধার ধারে না। দ্রুত ধাবমান জীবনে চিঠি লেখার অবকাশ কোথায়! আর মানি অর্ডারে টাকা পাঠানো এখন মৃত ইতিহাস। মোবাইল, এসএমএস, ই-মেইল আর ফেসবুক, ভাইবার, স্কাইপি, ইমু, হোয়াটসআপ সবার হাতে হাতে। এক নিমিষেই যুক্ত হওয়া যায় লাইভ কথোপকথনে।

মানি অর্ডারের বদলে মোবাইল ফোনে মানি ট্রান্সফার। অফিসিয়াল চিঠি ও ডকুমেন্ট পাঠাতে ব্যবহার হচ্ছে কুরিয়ার সার্ভিস। এই অবস্থায় বাংলাদেশের ডাক ব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে বটে। তবে তার গতি আশাব্যঞ্জক নয়। দেশে দেশে আধুনিক ডাকসেবায় ই-কর্মাসের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। সেই তুলনায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। চুয়াডাঙ্গার প্রবীণ ব্যক্তিত্ব ও ভাষা সৈনিক আমীর হোসেন জানান, প্রতিটি ডাকঘরে একজন ডাক বিলিকারী ও একজন পোস্ট মাস্টার রয়েছে। তবে ডাকঘর গুলোতে রানার বা ডাক বিলিকারীর কোনো খোঁজই মেলে না মাসান্তরে।

অন্যদিকে সপ্তাহান্তেও দেখা মেলে না পোস্টমাস্টারের। এরূপ করুণ অবস্থার কারণে ডাক বিভাগের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছেন অনেক মানুষ। এ অবস্থায় ডাক বিভাগের পুরাতন ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে আধুনিকীকরণের দাবি জানানো হয়েছে। শহিদুল ইসলাম নামে এক পোস্টমাস্টার জানান, আমাদের কোনো বেতন নেই, শুধু সম্মানী ভাতা দেয় ১২শ’ টাকা। এতে আমাদের সংসার চলে না। ফলে বাধ্য হয়ে অন্য কাজ করতে হয়। তবে চুয়াডাঙ্গা প্রধান ডাকঘরের পোস্ট মাস্টার জানান, ডাক বিভাগের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এগুলো তদারকি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও জানান, জেলা উপজেলা ডাকঘরগুলো বেশ ভালো চলছে। কাজের পরিধিও বেড়েছে। এদিকে একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল এই যুগে অনেক কিছুরই আধুনিকায়ন হলেও ডাক বিভাগের খুব একটা উন্নতি ঘটেনি। সরকারি ডাক বিভাগের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে বিভিন্ন সংস্থা কুরিয়ার সার্ভিস চিঠিপত্র ও টাকা পয়সা আদান-প্রদানের মাধ্যম ব্যাপক জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছে। এসব কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে অতি তাড়াতাড়ি ও সঠিক সময়ে সেবা পাওয়ায় মানুষের কাছে তা গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছে। সরকারি ডাক বিভাগ পুরনো ধ্যান-ধারণা বাদ দিয়ে আধুনিকায়নের মাধ্যমে আবারও জনপ্রিয় করার সুযোগ থাকলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত