ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্যদিয়ে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে জাতিসংঘ। অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের পাশেও রয়েছে। শুধু তাই নয়, ইউনূসের আমন্ত্রণে ১৩ মার্চ চার দিনের সফরে বাংলাদেশে আসছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। গতকাল বুধবার নিউইয়র্ক থেকে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের কার্যালয়ও সফরের তথ্য নিশ্চিত করেছে। এর আগে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জাতিসংঘের পূর্ণ সমর্থন ও জাতিসংঘের মহাসচিবের ঢাকা সফর প্রসঙ্গে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালানোর পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের দায়িত্ব নিয়েই সেপ্টম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দেন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ ওই সময়ে জাতিসংঘের অধিবেশন চলাকালীন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজেই ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের সঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সাক্ষাৎ করেছেন। সেখানেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জাতিসংঘের পূর্ণ সমর্থনের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এরপর গত মাসের ২২ জানুয়ারি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সম্মেলনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টার সুইজারল্যান্ডের দাভোসে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। এবার অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের আমন্ত্রণে জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশ সফরের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য গর্বের।
গত মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জাতিসংঘের পাঠানো এক চিঠিতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন নিশ্চিত করতে তার সংস্থা (জাতিসংঘ) আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও সক্রিয় করা অব্যাহত রাখবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে চলমান পরিবর্তন প্রক্রিয়াকে সমর্থন দিচ্ছে জাতিসংঘ।
চিঠিতে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের কারণে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের ওপর পড়া প্রভাব এবং রাখাইনে ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকট নিয়ে তিনি প্রধান উপদেষ্টার উদ্বেগের সঙ্গে একমত।
গুতেরেস বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও স্বেচ্ছামূলক প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করাসহ মিয়ানমারের সংকটের একটি রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক অংশীদার, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট (আসিয়ান) ও অন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আমি আমার বিশেষ দূতের মাধ্যমে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ চালিয়ে যাব।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, তিনি জাতিসংঘের বাংলাদেশ ও মিয়ানমারভিত্তিক কর্মী দলকে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য তার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের আহ্বান জানিয়েছেন, যেন তারা রাখাইন সম্প্রদায়ের জন্য মানবিক ও জীবিকার সহায়তা আরো বাড়াতে পারেন। গুতেরেস আশ্বস্ত করেন যে জাতিসংঘ এই ইস্যুতে অগ্রাধিকারভিত্তিতে কাজ করবে। যার মধ্যে জরুরি ত্রাণ সমন্বয়কারী ও মিয়ানমারের আবাসিক ও মানবিক সমন্বয়কারীর মাধ্যমে রাখাইনসহ সারা মিয়ানমারে নিরাপদ, দ্রুত, টেকসই ও বাধাহীন মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করাও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। গুতেরেস বলেন, ‘জাতিসংঘের ব্যবস্থা কীভাবে প্রক্রিয়াটিকে সর্বোত্তম সমর্থন করতে পারে, তা বোঝার জন্য সদস্যরাষ্ট্রের পরামর্শ অনুসরণ করে আমরা সম্মেলনের সম্মত ফলাফল ও পরিকল্পনার জন্য অপেক্ষা করছি।’
জাতিসংঘ মহাসচিব আবার নিশ্চিত করেন যে বিশ্ব সংস্থাটি (জাতিসংঘ) বাংলাদেশের প্রতি দৃঢ় সংহতি জানাচ্ছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে চলমান পরিবর্তন প্রক্রিয়াকে সমর্থন দিচ্ছে। ৪ ফেব্রুয়ারি মুহাম্মদ ইউনূসের পাঠানো চিঠির জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানান গুতেরেস। এই চিঠি গত ৭ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকের সময় তাঁর কাছে পৌঁছে দেন প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সংকট ও অগ্রাধিকারবিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান।
জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশ সফরে আসা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। যুক্তরাষ্ট্র ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সমর্থন ও স্বীকৃতি প্রদান করেছে। ড. ইউনূস সরকারের প্রশংসা করে সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এই সাধারণ আশ্বাসের পাশাপাশি জাতিসংঘের সমর্থন ইউনূস সরকারকে আরও বেশি চাঙ্গা করে তুলবে। যা আগামীতে লক্ষ্য করা যাবে। পতিত স্বৈরাচারের সঙ্গে শেষ মুহূর্তে জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্রের খুব একটা সুসম্পর্ক ছিল না। কারণ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতিসংঘ বারংবার উদ্বেগ জানালেও সেটি কর্ণপাত করেনি স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা।
এর আগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি জুলাই আন্দোলন দমন নিয়ে জাতিসংঘ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ওই রিপোর্টে বাংলাদেশে গত জুলাই-অগাস্টে প্রায় ১৪০০ জনের মতো নিহত হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগের মৃত্যু হয়েছে রাইফেল ও শটগানের গুলিতে। ওই সময় নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বয়কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাদের নির্দেশেই বিক্ষোভ দমনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্যের উল্লেখ করা হয়।
ওএইচসিএইচআর মনে করে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র অংশ এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জ্ঞাতে, সমন্বয়ে ও নির্দেশনায় এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, যেসব বিষয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে রয়েছে জীবনের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার, ব্যক্তি নিরাপত্তা, নির্যাতন ও বাজে আচরণ থেকে মুক্ত থাকার অধিকার, ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদার অধিকার, ন্যায়বিচারের অধিকার, ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রতিকার পাওয়ার অধিকারের মতো বিষয়গুলো। বিজিবি, র্যাব, ডিজিএফআই, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সরাসরি অপারেশন বিষয়ে আদেশ ও অন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যা তাদের বিক্ষোভকারী ও অন্য বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত করেছিল। এর মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্বিচারে গ্রেপ্তারের মতো ঘটনা ছিল।