বাংলাদেশে বাজারব্যবস্থার প্রসঙ্গ উঠলেই আলোচনায় চলে আসে ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটি। সিন্ডিকেট হলো, একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মিলে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া বা নির্দিষ্ট স্বার্থ হাসিলকে বোঝানো হয়। এ কাজ ভালো কিংবা খারাপ দুটোই হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে সিন্ডিকেট বলতে মূলত ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট বোঝায়। এ শব্দটি নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহার হয়।
যেখানে একদল ব্যবসায়ী বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে ইচ্ছেমতো পণ্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে এবং দাম বাড়িয়ে অবৈধভাবে মুনাফা অর্জন করে। ফলে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরাই বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। এতে জনসাধারণের জীবনযাত্রার ব্যয় লাগামহীন বেড়ে যায়। বাংলাদেশে কিছুদিন পরপর কোনো না কোনো পণ্য সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ছে। কখনও পেঁয়াজ, কখনও ডিম, আবার কখনও কাঁচা মরিচ। এছাড়া আটা, সয়াবিন তেল, এমনকি ডাব ও রোগীকে দেওয়া স্যালাইনও বাদ যাচ্ছে না সিন্ডিকেটের হাত থেকে। সবমিলিয়ে সিন্ডিকেট এখন সমাজে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। অথচ ইচ্ছেমতো পণ্যের মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধি করা সম্পূর্ণ অমানবিক ও নৈতিকতা বিবর্জিত। এজন্য ইসলামে সিন্ডিকেটকে সম্পূর্ণ হারাম। রাসুল (সা.) বলেন, ‘শুধু পাপী ব্যক্তিই মজুদদারি বা সিন্ডিকেট করে থাকে।’ (মুসলিম : ১৬০৫)। অন্য আরেক হাদিসে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ার বাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে রাখে, আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত করবেন অথবা দেউলিয়া বানাবেন।’ (আল-মুন্তাখাবুল আদাবি : ১৭)।
সিন্ডিকেটের মৌলিক যত কারণ : দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও এখন কঠিন সময় পার করছেন। তার মধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যেন বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে চেপে বসেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা, পূর্ব সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি, দেশব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চরম অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি সুযোগসন্ধানী অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট আস্ফালন যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের শত হুমকি-ধমকি-ধরপাকড়ও যেন তাদের একচুল টলাতে পারছে না। এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ ও বাজার-বিশ্লেষকরা দেশের মান্ধাতার আমলের বাজার কাঠামো পরিবর্তনের ওপর জোর দেন। সিন্ডিকেটের প্রভাব বিস্তারের পেছনে দেশের ইনফরমাল বাজার ব্যবস্থাপনাকে দুষছেন তারা। সাধারণত ফরমাল বাজার সিস্টেমে পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার হাত পর্যন্ত পৌঁছাতে যত এজেন্ট কাজ করে, তাদের সবাই নিবন্ধিত থাকেন বা প্রত্যেকের আলাদা বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর থাকে। অনিবন্ধিত কেউ এ বাজারে লেনদেন করতে পারে না। সেই সঙ্গে সরকারের নজরদারি সংস্থা বাজারের প্রতিটি পর্যায়ে লেনদেনের তথ্য খতিয়ে দেখতে পারে। কে কী পরিমাণ পণ্য মজুত রাখছেন, কে কী পরিমাণ পণ্য আমদানি করছেন বা বিক্রি করছেন, কী দামে বিক্রি করছেন, সব তথ্য সরকারের হাতে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারব্যবস্থাপনায় এর কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। এ কারণে সরকারের কোনো সংস্থা বাজারের কোনো লেনদেন নজরদারি করতে বা তথ্য রেকর্ড করতে পারে না। ফলে পুরো বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। বড় ব্যবসায়ীরা বাজারব্যবস্থার কাঠামোগত এ দুর্বলতার সুযোগটাই নিচ্ছে বলে জানান বিশ্লেষকরা।
সিন্ডিকেট রোধে করণীয় : দেশের অবৈধ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কাজ করতে সরকারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মানুষের সার্বিক কল্যাণের প্রতি খেয়াল রাখা ইসলামের অন্যতম মৌলিক আদেশ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কল্যাণকামিতাই ধর্ম।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কার জন্য হে আল্লাহর রাসুল!’ নবীজি বললেন, ‘আল্লাহ, রাসুল, মুসলিম নেতা ও সর্বসাধারণের জন্য।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৯৪৪)। সিন্ডিকেট সমস্যা সমাধানে সরকারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো অসাধু ব্যবসায়ী, মজুদদারি, কালোবাজারি ও দুর্নীতিসহ সব অবৈধ কার্যক্রম শক্ত হাতে দমন করে পুরো বাজারব্যবস্থাকে নতুন রূপে ঢেলে সাজানো। মোবাইল কোডের সাহায্যে বাজারে অনিয়ম স্থিতিশীল রাখতে হবে। অনিয়ম রুখতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কৃষিপ্রধান দেশে কৃষিপণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষি কর্মকর্তাসহ সরকারের সহযোগিতার মনোভাব স্থাপন করা চাই। কৃষিপণ্য সঠিক বাজারজাতকরণে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মধ্যসত্ত্বভোগী দালালদের দূরীকরণ নিশ্চিত করতে হবে। টিসিবির পণ্য যেন আসল দরিদ্ররা পায়, সেদিকে প্রশাসনের কড়া নজর রাখতে হবে। সিন্ডিকেটগুলোর উৎস বা মূল হোতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। সিন্ডিকেটের সঙ্গে আমদানিকারক, শিল্পপতি ও সরকারি কর্তাব্যক্তিদের যারা জড়িত থাকে, কেউ যেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকতে না পারে, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে রাঘব বোয়ালদের?ও আইনের আওতায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণের কর্তব্য হবে, সঠিক তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করে যথাসাধ্য সহযোগিতা করা।