ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম ড্রোন যুদ্ধ, নতুন অধ্যায়ের সূচনা

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম ড্রোন যুদ্ধ, নতুন অধ্যায়ের সূচনা

পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিশ্বের প্রথম ড্রোন যুদ্ধের সাক্ষী হলো ভারত এবং পাকিস্তান। গত বৃহস্পতিবার ভারতের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে, পাকিস্তান ভারতীয় ভূখণ্ড ও ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের তিনটি সামরিক ঘাঁটিতে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। তবে ইসলামাবাদ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান দাবি করেছে, তারা ২৫টি ভারতীয় ড্রোন ভূপাতিত করেছে। দিল্লি কিন্তু এখনো প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কিছু বলেনি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কয়েক দশকের পুরোনো দ্বন্দ্বে ?‘টিট-ফর-ট্যাট’ হামলার এই নীতি একটি ‘বিপজ্জনক’ এবং নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। কারণ উভয় পক্ষই অস্থিতিশীল সীমান্তে কেবল গোবারুদ নয়, ড্রোনের মতো মানবহীন অস্ত্রও ব্যবহার করেছে। ওয়াশিংটন ও অন্য বৈশ্বিক শক্তিগুলো যখন উভয়পক্ষকে ‘সংযম প্রদর্শনের’ আহ্বান জানাচ্ছে, তখন ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান কিন্তু দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার বৃদ্ধি একটা রিমোট (দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত), নীরব ও অস্বীকারযোগ্য সংঘাতের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।

ইউএস নাভাল ওয়ার কলেজের অধ্যাপক জাহারা মাতিসেক বিবিসিকে বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ একটা নতুন ড্রোন যুগে প্রবেশ করছে- যেখানে অদৃশ্য চোখ এবং আনম্যানড প্রিসিসন (মানবহীন পদ্ধতির নিখুঁত পরিমাপ) উত্তেজনা বা সংযম নির্ধারণ করতে পারে। সুতরাং দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আকাশে, ড্রোনযুদ্ধে পারদর্শী পক্ষরা শুধু যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করবে না, তাকে আকারও দেবে। পাকিস্তান অভিযোগ তুলেছে, বুধবার সকাল থেকে পাকিস্তান ও পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারতীয় বিমান হামলা ও সীমান্তে গোলাগুলিতে ৩৬ জন নিহত ও ৫৭ জন আহত হয়েছেন। অন্যদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে অন্তত ১৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে। ভারত জোর দিয়ে বলেছে, পহেলগাম হামলার জবাবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। এদিকে ইসলামাবাদ ২২ এপ্রিলের পহেলগাম হামলার পেছনে তাদের কোনো ধরনের ভূমিকার কথা অস্বীকার করেছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বৃহস্পতিবার ঘোষণা করেছে যে, তারা করাচি, লাহোর এবং রাওয়ালপিন্ডিসহ বিভিন্ন শহরে ২৫টি ভারতীয় ড্রোন ভূপাতিত করেছে। দাবি অনুযায়ী, ভূপাতিত করা ওই ড্রোনগুলো ইসরায়েলের তৈরি হ্যারোপ ড্রোন এবং প্রযুক্তিগত ও অস্ত্রভিত্তিক পাল্টা ব্যবস্থা ব্যবহার করে সেগুলো প্রতিহত করা হয়েছে। ভারত দাবি করেছে, পাকিস্তানের কয়েকটি বিমান প্রতিরক্ষা রাডার এবং সিস্টেম নিষ্ক্রিয় করেছে যার মধ্যে একটি লাহোরে অবস্থিত। ইসলামাবাদ এই দাবিকে খারিজ করে দিয়েছে। লেজার-গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র এবং বোমা, ড্রোন ও আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকলস (ইউএভি) আধুনিক যুদ্ধে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এগুলো সামরিক অভিযানের নির্ভুল হওয়া এবং নিখুঁত দক্ষতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে। এটা বিমান হামলার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট স্থানাঙ্কগুলো রিলে করতে পারে বা যদি ডিজাইন করা হয় তাহলে সরাসরি লেজার-ডেজিগনেশনের মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত করতে এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেওয়ায় সাহায্য করতে পারে। ড্রোন শত্রুর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দমন করতে বা ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। শত্রু রাডার নির্গমনকে ট্রিগার করার জন্য প্রতিযোগিতামূলক আকাশসীমায় উড়ে যেতে পারে যা পরে লয়টারিং ড্রোন বা অ্যান্টি-রেডিয়েশন ক্ষেপণাস্ত্রের মতো অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র দ্বারা নিশানা করা যেতে পারে। ইউক্রেন ও রাশিয়া দুজনেই তাদের যুদ্ধে এভাবেই কাজ করে। এই দ্বৈত ভূমিকা অর্থাৎ লক্ষ্যবস্তু করা এবং ট্রিগার করার বিষয়টা ড্রোনকে মনুষ্যবাহী বিমান ব্যবহারের ঝুঁকি ছাড়াই শত্রু আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে হ্রাস করার শক্তি বাড়িয়ে তোলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের ড্রোনের বহর মূলত আইএআই সার্চার এবং হেরনের মতো ইসরায়েলের তৈরি ইউএভি ও হার্পি এবং হ্যারোপ লোটারিং মিউনিশনের মতো করে নির্মিত, যে ড্রোনগুলো ক্ষেপণাস্ত্রের মতোই দ্বিগুণ ক্ষমতাসম্পন্ন, স্বায়ত্তশাসিত পুনরুদ্ধার করতে এবং নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে সক্ষম।

বিশেষজ্ঞদের মতে, হ্যারোপ (লয়টারিং মিউনিশন বা ভ্রাম্যমাণ যুদ্ধাস্ত্র) উচ্চমূল্যের, নির্ভুল-লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করার মাধ্যমে আধুনিক সংঘাতের ক্ষেত্রে লয়টারিং মিউনিশনের মতো যুদ্ধাস্ত্রের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হেরন শান্তিকালীন পর্যবেক্ষণ এবং যুদ্ধ অভিযান দুই ক্ষেত্রে আকাশের উচ্চতায় চোখ রাখতে ভারতকে সাহায্য করেছে। আইএআই সার্চার, এমকে-২ ফ্রন্টলাইন অভিযানের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যার সহনশীলতা ১৮ ঘণ্টার এবং এটা ৩০০কিলোমিটার পরিসীমা এবং ৭০০০ মিটারের সার্ভিস সিলিং সরবরাহ করে। অনেকে বিশ্বাস করেন যে, ভারতের যুদ্ধ ড্রোনের সংখ্যা পরিমিত, তবে সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩১টা এমকিউ-৯বি প্রিডেটর ড্রোন কেনার জন্য ৪০০ কোটি ডলারের চুক্তি করেছে ভারত। এই পদক্ষেপ ভারতের আঘাত হানার ক্ষমতাকে অনেকটাই বাড়িয়েছে। এই ড্রোন ৪০ ঘণ্টা ধরে উড়তে পারে এবং ৪০ হাজার ফুট উচ্চতায় যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের ড্রোনের বহরের কৌশলও বিকশিত হয়েছে। বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অভিভূত ও পরিপূর্ণ করার জন্য বিপুল সংখ্যক ছোট ইউএভি মোতায়েন করেছে ভারত। এতে ভারতের উচ্চমূল্যের সিস্টেমগুলো নির্দিষ্ট আকাশপথে প্রবেশ করতে পারে। লাহোর-ভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক এজাজ হায়দার বিবিসিকে বলেন, পাকিস্তানের ড্রোন বহর বিস্তৃত এবং বৈচিত্র্যময়। এতে দেশীয় সিস্টেম রয়েছে আবার আমদানি করা সিস্টেমও আছে। তিনি বলেন, পাকিস্তানের ঝুলিতে থাকা ড্রোনের তালিকায় এক হাজারেরও বেশি ড্রোন রয়েছে, যার মধ্যে চীন, তুরস্ক এবং দেশীয় নির্মাতাদের মডেল রয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে চীনা সিএইচ -৪, তুরস্কের বায়রাক্তার আকিনসি এবং পাকিস্তানের বুরাক ও শাহপার ড্রোন। পাকিস্তান তার আক্রমণ সক্ষমতা আরও বাড়িয়েছে এবং যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করেছে। এজাজ হায়দার জানিয়েছেন, পাকিস্তান বিমান বাহিনী (পিএএফ) প্রায় এক দশক ধরে সক্রিয়ভাবে তাদের অভিযানে আনম্যান্ড সিস্টেমকে (মনুষ্যবিহীন সিস্টেমকে) অন্তর্ভুক্ত করছে।

তিনি আরও বলেন, মূল ফোকাস হলো লয়াল উইংম্যান ড্রোনের বিকাশ। এটা মনুষ্যবাহী বিমানের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার জন্য ডিজাইন করা ইউএভি। অধ্যাপক মাতিসেক মনে করেন, হারোপ এবং হেরন ড্রোন সরবরাহকারী ইসরায়েলের প্রযুক্তিগত সহায়তা ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে তুরস্ক ও চীনা প্ল্যাটফর্মের ওপর পাকিস্তানের নির্ভরতা চলমান অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে তুলে ধরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক ড্রোন বিনিময়ের মাধ্যমে তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে যে ধরনের ড্রোনকেন্দ্রিক যুদ্ধ নজরে এসেছে, তার সঙ্গে এর স্পষ্টতই পার্থক্য রয়েছে। সেখানে ড্রোন সামরিক অভিযানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত