ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ আরও ছয় সপ্তাহের জন্য বাড়াতে চায় ইসরায়েল। মিসরের রাজধানী কায়রোতে শুরু হওয়া আলোচনায় ইসরায়েলি প্রতিনিধিদল প্রথম ধাপের সময়সীমা বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বলে মিসরের দুটি নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছে। সূত্র দুটি বলেছে, যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ সম্প্রসারণের বিরোধিতা এবং চুক্তির দ্বিতীয় পর্যায় শুরুর ওপর জোর দিয়েছে হামাস। দ্বিতীয় ধাপের চুক্তি যুদ্ধের স্থায়ী অবসান ঘটাবে; এ কারণে এই ধাপে পদার্পণের ওপর জোর দিচ্ছে গাজার শাসকগোষ্ঠী। ইসরায়েল-হামাসের মধ্যে স্বাক্ষরিত এই চুক্তির প্রথম ধাপের মেয়াদ শনিবার শেষ হওয়ার কথা। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে নতুন করে কোনো চুক্তি না হলে কী ঘটবে, সেই বিষয়ে যুদ্ধরত উভয়পক্ষ পরিষ্কার করে কিছু জানায়নি। ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের অবসানে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে মিসর ও কাতার উভয়পক্ষের আলোচনায় মধ্যস্থতা করছে।
গত শুক্রবার হামাস এক বিবৃতিতে কোনো ধরনের কালক্ষেপণ না করে অবিলম্বে চুক্তির দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশে ইসরায়েলের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ইসরায়েল যেন চুক্তির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্বে প্রবেশ করে, সেজন্য চাপ প্রয়োগ করতে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি জোরালোভাবে আহ্বান জানাচ্ছি।’ এর আগে, ইসরায়েলের দুই সরকারি কর্মকর্তা বলেন, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপের মেয়াদ ৪২ দিন বাড়াতে চায়। সেই সঙ্গে ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি ফিলিস্তিনিদের বিনিময়ে প্রতি সপ্তাহে তিনজন করে বন্দির মুক্তি চায় তেলআবিব।
হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে শুক্রবার মিসরের রাজধানী কায়রোতে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। মধ্যস্থতাকারীদের আশা, এই আলোচনার মধ্য দিয়ে গাজাযুদ্ধের অবসান হবে। মিসর বলেছে, যুদ্ধবিরতির পরবর্তী ধাপ নিয়ে নিবিড় আলোচনায় অংশ নিতে ইসরায়েল, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল কায়রোতে অবস্থান করছে। মিসরের সরকারি সংস্থা স্টেট ইনফরমেশন সার্ভিস বলেছে, আগে সম্মত সমঝোতা বাস্তবায়নে চলমান প্রচেষ্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো যুদ্ধবিরতি চুক্তির পরবর্তী ধাপগুলো নিয়ে নিবিড় আলোচনা শুরু করেছে। এদিকে, যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে আলোচনা বেশ ভালোভাবে চলছে বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউজে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে জানতে চাওয়া হয়, দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতি ফলপ্রসূ হবে কি না। জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা দেখছি কী হয়। কেউ আসলে জানে না, তবে আমরা আন্তরিকভাবে দেখছি। আমাদের মধ্যে ভালোই আলোচনা চলছে।’ তবে এ-নিয়ে বিস্তারিত আর কিছু জানাননি ট্রাম্প। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ছয় শতাধিক ফিলিস্তিনি বন্দির বিনিময়ে হামাস চার বন্দির লাশ হস্তান্তর করার পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কায়রোতে আলোচকদের পাঠান। প্রথম দিনের আলোচনা শেষে এই প্রতিনিধিদল ইসরায়েলে ফিরে গেছে বলে খবরে বলা হয়। গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় তিন ধাপের যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ কার্যকর হয়। এরইমধ্যে হামাসের হাতে আটক ৩৩ ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। বিনিময়ে ইসরায়েলি কারাগারে থাকা প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি মুক্তি পেয়েছেন।
এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের কাছে আরও তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে। এ-সব সরঞ্জামের মধ্যে আছে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ, বুলডোজার এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম। ইসরায়েল অতীতে ঘনবসতিপূর্ণ গাজায় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে এ ধরনের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বুলডোজার ব্যবহার করেছে। এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও শুক্রবার এই অস্ত্র বিক্রিতে তড়িঘড়ি করে অনুমোদন দেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা নিরাপত্তা সহযোগিতা সংস্থা জানিয়েছে, ইসরায়েলের কাছে ২ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলারের বম্ববডি ও ওয়ারহেড, ৬৭৫ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারের অন্যান্য বম্ববডি ও গাইডেন্স কিট এবং ২৯৫ মিলিয়ন ডলারের বুলডোজার ও সংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম সরবরাহ করা হবে। প্রতিরক্ষা নিরাপত্তা সহযোগিতা সংস্থা আরও জানিয়েছে, রুবিও জরুরি পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ইসরায়েলকে এই সামরিক সরঞ্জাম দ্রুত সরবরাহ করা প্রয়োজন। এ-কারণে কংগ্রেসের অনুমোদনের যে প্রয়োজন হয়, তা শিথিল করা হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ইসরায়েলকে শক্তিশালী রাখতে এবং তাদের আত্মরক্ষা সক্ষমতা বজায় রাখতে সহায়তা করা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’ এদিকে, এই অস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে বলছে, এটি মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত আরও তীব্র করবে এবং বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বাড়াবে। মার্কিন কংগ্রেসের কিছু সদস্য এবং বিভিন্ন দেশ এই অস্ত্র বিক্রির বিরোধিতা করছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজা উপত্যকার বিরুদ্ধে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালানোর যে পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন, তার বিরুদ্ধে জর্দানে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। রাজধানী আম্মানে শুক্রবার জুমার নামাজের পর অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশ নেন। তারা গাজাবাসীকে এই উপত্যকা থেকে বিতাড়িত করার মার্কিন পরিকল্পনার ঘোর বিরোধিতা করেন। জর্দানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আম্মানের আল-হুসেইনি মসজিদ থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয় এবং আন-নাখিল স্কয়ারে গিয়ে শেষ হয়। রাজধানী ছাড়াও জর্দানের প্রায় সব ছোট-বড় শহরে শুক্রবার ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরোধিতা করে বিক্ষোভ হয়েছে। গাজাবাসীকে মিসর ও জর্দানে সরিয়ে দেয়ার মার্কিন পরিকল্পনার বিরোধিতা করে জর্দানের বিক্ষোভকারীরা বলেন, যুদ্ধ ও অবরোধ চাপিয়ে দেয়ার পরও গাজাবাসী শক্তিশালী রয়েছে। গাজাবাসীর এই দৃঢ়তার প্রতি আমাদের সমর্থন রয়েছে এবং তাদের যে কোনো ধরনের প্রয়োজনে আমরা তাদের পাশে রয়েছি। বিক্ষোভকারীরা বলেন, জর্দানের সরকার ও জনগণ একটি বাক্যের ব্যাপারে একমত। আর তা হলো- ‘গাজাবাসীর জন্য কোনো বিকল্প বাসস্থান গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের বিতাড়িত করা যাবে না।’