বাংলা-সাহিত্যাকাশে ধূমকেতুর মতো যার আবির্ভাব তিনি হলেন, আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। পরাধীনতার শৃঙ্খল ও লাঞ্ছনা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, শোষণ-নিপীড়ন তাকে বারবার ভাবিয়ে তুলেছে। কাজী নজরুল ইসলাম একজন স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তার সকল বিদ্রোহ প্রকাশ পেয়েছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রধান বিদ্রোহ ছিল রাজনৈতিক পরাধীনতা, অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে- মহাবিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত,/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না- / অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না /বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত। (বিদ্রোহী) ‘বিদ্রোহী’ কবিতার চতুর্থ স্তবকে কবি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক, আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান বেদুঈন আবার কখনও বা ইতিহাস-খ্যাত ধ্বংসের নায়ক চেঙ্গিস খান- আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক,/ আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,/আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শেষ স্তবকে কবি সৃষ্টিতে অসাম্যের জন্য স্রষ্টার প্রতি অভিমান এবং অভিযোগ ব্যক্ত করেছেন যদিও প্রতীকগুলো পুরাণ কাহিনির- আমি বিদ্রোহী ভৃ-, ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদণ্ডচিহ্ন;/আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃ-, ভগবান-বুকে এঁকে দেবো পদণ্ডচিহ্ন! মূলত বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের পর পরই নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ অভিধাটা নিজের দখলে চলে আসে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা কখন কোন্ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সে নিয়েও বিতর্ক আছে। এ কবিতা নিয়ে পাঠক সমাজে, নজরুল গবেষক ও পণ্ডিত মহলে যে তর্ক-বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে বাংলাসাহিত্যে আর কোনো কবিতার ক্ষেত্রে তেমন দেখা যায়নি। ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার কার্তিক ১৩২৮ সংখ্যায় প্রকাশের জন্য কবি মোজাম্মেল হকের পুত্র আফ্জালুল হক কবিতাটি গ্রহণ করেন এবং উক্ত সংখ্যায় তা মুদ্রিত হয়। কিন্তু ‘মোসলেম ভারত’ প্রকাশে বিলম্ব হতে পারে এই আশংকায় সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকার জন্যও কবিতাটি নেওয়া হয় এবং উক্ত পত্রিকার ২২ পৌষ ১৩২৮ ‘বিদ্রোহী’ মুদ্রিত হয়। উক্ত উদ্ধৃত কবিতাটি ‘মোসলেম ভারত’ থেকে উদ্ধৃত বলেও উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে মুজফ্ফর আহমদ লিখেছেন, “১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি (মুতাবিক ২২ পৌষ ১৩২৮ বঙ্গাব্দ) তারিখে, শুক্রবারে ‘বিদ্রোহী’ ‘বিজলী’তেই প্রথম ছাপা হয়েছিল।... কাজেই, ‘বিদ্রোহী’ প্রথম ছাপানোর সম্মান সাপ্তাহিক বিজলী’রই প্রাপ্য।” (পৃষ্ঠা ১২৩, কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা)।
তবে ‘মোসলেম ভারত’ই প্রথম এই কবিতাটি পাওয়ার সৌভাগ্যের দাবিদার। ‘মোসলেম ভারত’ অতি অনিয়মিত পত্রিকা ছিল বলেই অবিনাশচন্দ্রের অনুরোধে নজরুল ঐ কবিতা ‘বিজলী’তেও দিয়েছিলেন। সুতরাং ‘বিদ্রোহী’ কবিতা মুদ্রিত আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘বিজলী’ পত্রিকায়। ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় কবিতাটি প্রকাশিত হয় ১৯২১ সালের অক্টোবর-নভেম্বর সংখ্যায় (কার্তিক ১৩২৮), যদিও পত্রিকাটি বেরিয়েছিল উল্লিখিত তারিখের অনেক পরে। নজরুল ইসলামের জন্য ‘বিদ্রোহী’ ছিলো একটি মাইলফলক। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পরই তাঁর কবি-প্রতিষ্ঠা খুব বেশি রকমে বেড়ে যায়। এ বিষয়ে মুজফ্ফর আহমদ লিখেছেন, “শুনেছিলাম সেই সপ্তাহের ‘বিজলী’ দু’বারে ঊনত্রিশ হাজার ছাপা হয়েছিল।... ধরতে পারা যায়, প্রায় দেড় দু’লাখ লোক কবিতাটি পড়েছিল। তার ফলে নজরুলের কবি-প্রতিষ্ঠা খুব বেশি রকম বেড়ে গেল।” (পৃষ্ঠা ১২৪, কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা)।
নজরুল গবেষকের অনেকেই মনে করেন, বাংলা ভাষায় সর্বাধিক পঠিত কবিতা হলো- ‘বিদ্রোহী’। ‘বিদ্রোহী’র মতো বিস্ময় সৃষ্টিকারী কবিতা বাংলাসাহিত্যে একক, অদ্বিতীয়। ঐতিহাসিক এ ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আবেদন কোনোদিন শেষ হবে না। অনন্ত যৌবনা ‘বিদ্রোহী’র আবেদন থাকবে আজীবন- অনাগত কালের অগণিত বাঙালির কাছে।