ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কারবালা : অন্যায়ের বিরুদ্ধে চিরকালীন প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
কারবালা : অন্যায়ের বিরুদ্ধে চিরকালীন প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি

কারবালা ইরাকের অন্তর্গত একটি শহর এবং কারবালা প্রদেশের রাজধানী। এটি ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান, বিশেষ করে শিয়া মুসলিমদের কাছে। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় কিছু ঘটনা চিরকাল মানুষের অন্তরকে আলোড়িত করে। এমনই এক শোকাবহ, বেদনাবিধুর ও গৌরবময় ঘটনা হলো কারবালার প্রান্তরে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তাঁর সঙ্গীদের আত্মত্যাগ। ৬১ হিজরির ১০ মহররম, ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত এ ঘটনা শুধু মুসলিম উম্মাহর নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য ন্যায়, নীতি ও সত্যের পথে অবিচল থাকার এক অনন্য শিক্ষা। কারবালা হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীনতা ও অধিকার রক্ষার প্রতীক।

কারবালার পটভূমি : হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ছিলেন ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী। তিনি সত্য, ন্যায় ও ইসলামের শাশ্বত মূল্যবোধ রক্ষায় ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। অন্যদিকে ইয়াজিদ ছিল এক অত্যাচারী শাসক, যে ইসলামের মূল চেতনা ও শাসনব্যবস্থাকে বিকৃত করতে চেয়েছিল। ইয়াজিদের জুলুম, স্বেচ্ছাচারিতা ও ধর্মদ্রোহিতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান ইমাম হোসাইন (রা.)। মদিনা থেকে মক্কা, সেখান থেকে ইরাকের কুফাবাসীর ডাক পেয়ে ইমাম হোসাইন (রা.) যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু কুফার জনগণ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ইয়াজিদের সেনাবাহিনীর ভয়ে নতিস্বীকার করে। কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবার-পরিজন এবং সাহাবিরা চারিদিক থেকে ঘেরাও হয়ে যান।

কারবালার শিক্ষা : কারবালার আত্মত্যাগ আমাদের যে অমোঘ শিক্ষা দেয়, তা যুগে যুগে প্রাসঙ্গিক। এর মূল শিক্ষা হলো ন্যায়ের পক্ষে অবিচল থাকা : অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপস না করে সত্যের জন্য আত্মবলিদান দেওয়া।

অত্যাচারীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ : ইয়াজিদের মতো শাসকের অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা।

ধর্ম ও ন্যায় রক্ষার জন্য আত্মোৎসর্গ : ইসলামের মূল্যবোধ ও সত্যের আদর্শ রক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা।

কারবালা ও মুসলিম উম্মাহ : কারবালার ঘটনা মুসলিম সমাজে গভীর প্রভাব ফেলেছে। শোকাবহ এই ঘটনাকে স্মরণ করে প্রতি বছর আশুরা পালন করা হয়। এই দিনে মুসলিমরা রোজা রাখেন, দোয়া করেন, দান-খয়রাত করেন এবং কারবালার আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করেন। শিয়া সম্প্রদায় বিশেষভাবে শোক মিছিল, মজলিস ও মাতমের মাধ্যমে ইমাম হোসাইনের শহাদতকে স্মরণ করে।

কারবালা ও মানবতার শিক্ষা : কারবালার শিক্ষা শুধুমাত্র মুসলিম উম্মাহর জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্যও প্রযোজ্য।

এটি আমাদের শেখায় মানবাধিকার রক্ষা : নিপীড়িতের পাশে দাঁড়ানো।

স্বাধীনতা ও ন্যায়ের জন্য লড়াই : দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা।

বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠা : অন্যায় ও জুলুমের বিপরীতে নির্ভীক হওয়া।

কারবালা ইতিহাসের দর্পণে : কারবালা ইতিহাসের এক অমর মহাকাব্য। সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্বে কারবালার ঘটনা চিরকাল জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্ত। ইসলামের ইতিহাসের পাতায় এ ঘটনা লেখা আছে রক্তাক্ষরে।

বহু কবি-সাহিত্যিক কারবালার বেদনা, ত্যাগ ও শিক্ষা নিয়ে লিখেছেন কবিতা, উপন্যাস, নাটক। আল্লামা ইকবালের কবিতা থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যের কবিরাও কারবালার শহিদদের অমর স্মৃতিকে ধারণ করেছেন।

কারবালা ও আমাদের জীবন : আমাদের ব্যক্তিজীবনেও কারবালার শিক্ষা বাস্তবায়ন করা জরুরি। সত্যের জন্য আপসহীন থাকা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা আমাদের মূল শিক্ষা হওয়া উচিত। আজকের সমাজে ন্যায়বিচারহীনতা, দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার যখন বেড়ে চলেছে, তখন ইমাম হোসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগের আদর্শ আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে অনুপ্রাণিত করে।

কেন সংঘটিত হয় কারবালার যুদ্ধ : হোসাইন (রা.)-এর সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল খিলাফত ব্যবস্থার পুনর্জীবন। ইয়াজিদের বিরুদ্ধে কুফাবাসীর সাহায্যের প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হয়ে হোসাইনের (রা.) স্ত্রী, ছেলে, বোন ও ঘনিষ্ঠ ২০০ অনুচর নিয়ে ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে কুফার উদ্দেশে রওনা হন। ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা নামক স্থানে পৌঁছালে কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ তাকে বাধা দেন। রক্তপাত ও খুনাখুনি বন্ধের উদ্দেশে হজরত হোসাইন (রা.) তিনটি প্রস্তাব দেন। ১. তাকে মদিনায় ফিরে যেতে দেওয়া হোক। ২. তুর্কি সীমান্তের দুর্গে অবস্থান করতে দেওয়া হোক। ৩. ইয়াজিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য দামেস্কে পাঠানো হোক। কিন্তু ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে তার হাতে আনুগত্যের শপথ নিতে আদেশ দেন। হজরত হোসাইন (রা.) ঘৃণা ভরে তার এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন। অবশেষে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের চার হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী হজরত হোসাইনকে (রা.) অবরুদ্ধ করে ফেলে এবং ফোরাত নদীতে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেয়। হজরত হোসাইন (রা.)-এর শিবিরে পানির হাহাকার শুরু হয়। তিনি ইয়াজিদ বাহিনীর উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, ‘আমি যুদ্ধ করতে আসিনি, এমনকি ক্ষমতা দখল আমার উদ্দেশ্য নয়। খিলাফতের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার আমার ইচ্ছা।’

কখন শুরু হয় কারবালার যুদ্ধ : ইয়াজিদ বাহিনী ১০ মহররম হজরত হোসাইন (রা.)-এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ অসম যুদ্ধে একমাত্র ছেলে হজরত জায়নুল আবেদিন (রহ.) ছাড়া ৭০ থেকে ৭২ জন শহিদ হন। হজরত হোসাইন (রা.) মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে যান। অবশেষে তিনি শহিদ হন। হজরত হোসাইন (রা.)-এর ছিন্ন মস্তক বর্শা ফলকে বিদ্ধ করে দামেস্কে পাঠানো হয়। ইয়াজিদ ভীত ও শঙ্কিত হয়ে ছিন্ন মস্তক প্রত্যর্পণ করলে কারবালা প্রান্তরে তাকে কবরস্থ করা হয়। ইতিহাস সাক্ষী, হজরত হোসাইন (রা.)-কে কারবালা প্রান্তরে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল, মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে করুণ পন্থায় তাদের প্রত্যেকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। (সূত্র: কারবালার ইতিহাস, আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.)।)

ইয়াজিদ কে? : ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান (রা.) খিলাফত লাভের মাধ্যমে উমাইয়া পরিবার প্রথম ক্ষমতায় আসে। তবে উমাইয়া বংশের শাসন খিলাফত ব্যবস্থা শুরু করেন মুয়াবিয়া (রা.)। উমাইয়াদের প্রথম খলিফা হচ্ছেন হজরত মুয়াবিয়া (রা.)। হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-কে আরব বিশ্বের প্রথম রাজা বলা হয়। ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান। (২০ জুলাই ৬৪৭-১৪ নভেম্বর ৬৮৩) সাধারণভাবে প্রথম ইয়াজিদ বলে পরিচিত তিনি। উমাইয়া খিলাফতের দ্বিতীয় খলিফা। উত্তরাধিকার সূত্রে খিলাফত লাভকারীদের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম খলিফা হন। তার পিতার প্রথম মুয়াবিয়া মৃত্যুর পর ৬৮০ সনের এপ্রিল মাসে মসনদে আরোহণ করে। তিনি ৬৮০ থেকে ৬৮৩ সাল পর্যন্ত তিন বছর শাসন করেন। কারবালার যুদ্ধের পর ইয়াজিদের কী হয়েছিল? : ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বেদনার ঘটনার নাম ‘কারবালা’। এই দিন মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় নাতি ইমাম হোসাইন ও তার ৭২ জন সঙ্গীকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী তিনজন ব্যক্তি। এরা হলেন শিমার বিন জুলজওশান যিনি নিজ হাতে খুন করেছিলেন ইমাম হোসাইনকে, এরপর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ যিনি ছিলেন তখনকার কুফার গভর্নর। ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া যার নির্দেশেই সম্পন্ন হয়েছিল কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা। কিন্তু এমন জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের পর শেষ পরিণতি কী হয়েছিল এই তিন ব্যক্তির?

ইসলামে ইয়াজিদ একমাত্র খলিফা যার দ্বারা ইসলাম সবচেয়ে বেশি অবদমিত হয়েছে। ৬৮০ সালের মে মাসে ক্ষমতা গ্রহণের চার মাসের মাথায় শুরু করে যুদ্ধ। কারবালার যুদ্ধ। হত্যা করে শেষ নবীর প্রিয় নাতি ইমাম হোসাইনকে। এরপর দ্বিতীয় বছরে আক্রমণ করে মদিনা। লন্ডভন্ড করে দেয় মসজিদে নববী। আর জীবনের শেষ বছরে এসে ইয়াজিদ আগুন লাগিয়ে দেয় মুসলমানের সবচেয়ে পবিত্র স্থান কাবা ঘরে। এই দিন বড় অপরাধের জন্য মুসলমানদের কাছে ইয়াজিদ এক ঘৃণিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়। কাবা ঘরে আগুন লাগানোর ১১ দিনের মাথায় রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয় ইয়াজিদের। শেষ হয় তার ৩ বছর ৯ মাসের ক্ষমতা। সময়টা ১২ নভেম্বর ৬৮৩। ইসলাম মুক্ত হয় এক জালেম শাসকের হাত থেকে।

কীভাবে মৃত্যু হলো ইয়াজিদের? : এই নিয়ে আছে নানা মত। তার মৃত্যুর অনেক কয়েকটি কারণ সন্দেহ করা হয়। কেউ কেউ বলেন, এক বিরল রোগে আক্রান্ত হন ইয়াজিদ। অজানা এই রোগের কোনো ধরনের চিকিৎসা দিতে পারেনি চিকিৎসকরা। কেউ কেউ বলে এসময় তিনি প্রচণ্ড পানির তৃষ্ণায় ভুগতেন; কিন্তু পানি দিলেই খেতে পারতেন না সেই পানি। এমনভাবে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে পানির তৃষ্ণায়, শেষ পর্যন্ত মারা যায় ইয়াজিদ।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত