ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অতিআগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। অনেক বিষয়ে ইসি আগ বাড়িয়ে বক্তব্য দেওয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে পাল্টা বক্তব্য আসতে দেখা গেছে। আবার সংস্কারের জন্য অপেক্ষা না করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার যে প্রস্তুতির কথা বলছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি, এ বিষয়কে ভিন্নভাবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইসি সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, কিন্তু সরকারের সহায়তা ছাড়া নির্বাচন আয়োজন করা অসম্ভব। এ কারণে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইসি ও সরকারের মধ্যে সমন্বয় আরও বাড়ানো দরকার।
সম্প্রতি ইশরাক হোসেনের গেজেট নিয়ে ইসি ও সরকারের মধ্যে একটা দূরুত্ব দেখা গেছে। এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপের বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু জানানো না হলেও একজন নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা কবে ঘোষণা করা হবে, সে বিষয়ে বক্তব্য দেন। পরে কয়েকটি দল ইসির সঙ্গে দেখা করে নির্বাচন নিয়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলার কারণ জানতে চায়।
জানা জায়, নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো করতে গিয়ে কিছু ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে ইসির দূরত্ব দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদের সীমানা নির্ধারণসংক্রান্ত আইনের খসড়া উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এজেন্ডাভুক্ত হওয়ার পরও তা প্রত্যাহার করে নেয় আইন মন্ত্রণালয়। ওই সংশোধনীর অধ্যাদেশ জারি না হওয়ায় সীমানা নির্ধারণে মাঠপর্যায়ের কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। জুনের মধ্যে এই কাজ শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে ইসির। এছাড়া ১৯ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এক চিঠিতে জাতীয় নির্বাচনের মূল আইন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ’ (আরপিও), ‘রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা’সহ ৯টি বিষয়ে সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর ইসির মতামত চেয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, ওই ৯টি বিষয়ে সংস্কার কমিশনের সব সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে মনে করছে কমিশন। নির্বাচন কমিশন নিজস্ব গতিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মধ্যে সরকারের এই চিঠি ইসির কাজে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলেছে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরে ভোটগ্রহণ হবে- এমন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। ডিসেম্বরে ভোটগ্রহণ করতে হলে অক্টোবরে তফশিল ঘোষণা করতে হবে। ওই সময়সীমা সামনে রেখে কাজগুলো এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
দ্রুত ভোট করতে ইসির তোড়জোড় : জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগে যেসব মৌলিক প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, তার প্রায় সবই এগিয়ে রাখছে ইসি। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন এবং ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম। এ দুটি কার্যক্রম চলমান। জুনের মধ্যে এসব কাজ শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে ইসির। এছাড়া ‘বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক নীতিমালা’, ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা’ (দেশীয়), ‘গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য নীতিমালা’ এবং ‘ভোটকেন্দ্র স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’র সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেছে ‘সীমানা পুনর্নির্ধারণ, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন প্রস্তুতি, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত ও তদারকি’ কমিটি। এই কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার।
অন্য প্রস্তুতির মধ্যে রয়েছে- স্বচ্ছ ব্যালট বক্স, স্ট্যাম্প প্যাড, বিভিন্ন ধরনের সিলসহ ভোটগ্রহণের সরঞ্জাম সংগ্রহ। সরঞ্জাম সংগ্রহে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সঙ্গে ইসির এক ধরনের সমঝোতা হয়েছে। ১২ ধরনের সরঞ্জাম সরবরাহ করতে ইউএনডিপিকে চিঠি দিয়েছে ইসি। পাশাপাশি টেন্ডারের মাধ্যমে সরঞ্জাম কেনার দরকার হলে সেই বিকল্প প্রস্তুতিও নিয়ে রাখছে ইসি সচিবালয়।
এদিকে বিভিন্ন দল ও সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের কথা বলা হলেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দীন বলেছেন, ঐকমত্য কমিশনের সংস্কারের দিকে তাকিয়ে থাকবেন না তারা। নিজেদের ক্ষমতার মধ্যে যা যা আছে, তা নিয়েই ভোটের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
সিইসি এমন সময়ে এ মন্তব্য করলেন, যখন ‘নির্বাচন আগে, না সংস্কার আগে’ বিতর্ক জমে উঠেছে। এরইমধ্যে বহুল আলোচিত সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। সেই কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা এগিয়ে যাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে নাগাদ হবে, সেটি অন্তর্বর্তী সরকার বলার কথা, ইসি নিজে থেকে কিছু বলতে পারে না। কারণ এখন সংসদ নেই, সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকার যা বলবে, সেই অনুযায়ী ইসিকে চলতে হবে। এবারকার সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইসির কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বুঝতে হবে।
সূত্র আরও জানায়, নির্বাচনের পূর্ব প্রস্তুতির বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকার বলতে পারবে। কিন্তু দেখা গেছে, বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বশীল কর্তা-ব্যক্তিরা আগ বাড়িয়ে নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন। প্রায় ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বিশেষ কোনো দল ক্ষমতায় আসতে পারে, সেজন্য আগ বাড়িয়ে কেউ কেউ সেই দলের হয়ে কাজ করছেন। ওই দল যা চাচ্ছে তা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছেন, যা তাদের কর্মকাণ্ডে ফুটে উঠেছে।
সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেই নির্বাচনের দিকে দেশ এগিয়ে যাবে। সরকার কিংবা ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে কয়েক সপ্তাহ ধরে নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে শোনা কথাগুলোর সঙ্গে সিইসির বক্তব্য পাশাপাশি রাখলে ভিন্ন ব্যঞ্জনা তৈরি হয়। সিইসি আরও বলেন, রাজনৈতিক বিষয়ে উদ্যোগ নেবে ঐকমত্য কমিশন। সেটি নিয়ে কথা বলতে চায় না ইসি। তবে ভোটের প্রস্তুতিতে নির্বাচনের আগে যা যা করা দরকার, নিজেদের ক্ষমতাবলে সেসব কাজ সম্পন্ন করবে ইসি।
অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) নতুন মেয়র হিসেবে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে গেজেট প্রকাশের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের জন্য অপেক্ষা করেনি ইসি। নির্বাচন কমিশন মন্ত্রণালয়ের মতামত ছাড়াই গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।
সম্প্রতি জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এ তথ্য জানিয়ে বলেন, ইশরাক হোসেনের গেজেট নোটিফিকেশন হবে কি না, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল। নির্বাচন কমিশন তো আসলে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, আমাদের মতামত জানার প্রয়োজন ছিল না। এজন্য তাদের সিদ্ধান্ত তাদেরই নেওয়ার কথা। আমাদের কাছে যখন মতামত নিতে পাঠিয়েছিলেন, তখন আমরা সংশ্লিষ্ট আইন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছি। এতে আমরা জানতে পেরেছি, নির্বাচনি যে প্লেইন্ড আছে সেটা নাকি পরিবর্তন করা যায় না। কারণ সেখানে নাকি হাইকোর্টের রায় রয়েছে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘ইশরাক সাহেব নাকি পরবর্তী সময়ে প্লেইন্ড পরিবর্তন করেছিলেন। সেজন্য আমরা দ্বিধান্বিত ছিলাম, এটা কি গেজেট নোটিফিকেশন হবে নাকি আপিল করতে হবে। তবে নির্বাচন কমিশন আমাদের মতামতের জন্য অপেক্ষা করেনি। ওনারা নিজেরা গেজেট নোটিফিকেশন করেছেন। এখানে আমার বলার কিছু নেই।’
পরে ইসি জানায়, নির্ধারিত সময়ে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত না আসায় নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের আদেশ বাস্তবায়ন করতেই ইশরাক হোসেনের নামে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনার সানাউল্লাহ বলেন, আদালতের আদেশের যেন ব্যত্যয় না ঘটে, সেজন্য গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।
গত ২৭ মার্চ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ২০২০ সালের নির্বাচনে শেখ ফজলে নূর তাপসকে বিজয়ী ঘোষণার ফল বাতিল করে বিএনপি নেতা ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে রায় দেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম।
রায়ের কপি পেয়ে ২২ এপ্রিল গেজেট প্রকাশের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ চায় ইসি। এরপর ২৭ এপ্রিল ইশরাক হোসেনকে ডিএসসিসির মেয়র ঘোষণা করে কমিশন। পরদিন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, মন্ত্রণালয়ের মতামত দেওয়ার আগেই ইসি বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের নামে গেজেট প্রকাশ করেছে।