মূলত বৈকাল হ্রদ সাইবেরিয়ার দুটি প্রজাতন্ত্রের সীমানা ঘেঁষে বিস্তৃত। উত্তর-পশ্চিম অংশ পড়েছে ‘ইরকুটস্ক’ প্রজাতন্ত্রে। দক্ষিণ-পূর্ব অংশ পড়েছে ‘বুরিয়াতিয়া’ প্রজাতন্ত্রে। এই এলাকায় বুরিয়াত সম্প্রদায়ের লোকজনই বেশি। হ্রদ ঘিরেই ওদের জীবনসংগ্রাম। এই সম্প্রদায়ের একটা অংশ সভ্যসমাজে বসবাস করলেও অন্যরা বাস করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তবে এদের সঙ্গে সভ্য সমাজের যোগাযোগ থাকলেও সয়তিদের সভ্য সমাজের সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগ নেই। এমনকি ‘ওকা’ অঞ্চলের সয়তিদের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই। প্রাকৃতিক পরিবেশেই ওরা জীবন যাপনে অভ্যস্ত। রক্তহিম করা ঠান্ডায় তৈগা বনাঞ্চলের আশপাশেই তাঁবু খাটিয়ে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছে যুগ যুগ ধরে। মূলত তাদের জীবন সংগ্রামই হচ্ছে গবেষকদের থিসিসের বিষয়বস্তু। যার জন্য দুজন হ্রদের দক্ষিণ-পূর্ব রাজ্যের স্টেশনটাতেই নেমেছে। স্টেশনে একরাত কাটিয়ে চলে যাবে বৈকাল পর্বতমালার মালভূমিতে। গবেষণায় ফলপ্রসূ হলে পরবর্তীতে বুরিয়াতদের সঙ্গে কয়েকদিন কাটিয়ে থিসিসের কাজ সম্পন্ন করবে। কাজেই ওদের হ্রদ পাড়েও কয়েকদিন কাটাতে হবে। তবে সেটা এখুনি নয়; ফেরার পথে। তাই এখানে আর সময় নষ্ট না করে আগামীকালই বৈকাল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
হ্রদ পাড়ে কিছু সময় কাটিয়ে একটা হোটেলে উঠেছে দুজন। পরের দিনের যাত্রা বৈকাল পর্বতমালায়। এখানে ট্রেনের টিকিট পেতে সমস্যা হয় না তেমন। যাত্রীর সংখ্যা হাতেগোনা বিধায় তাৎক্ষণিক টিকিট সংগ্রহ করা যায়। এছাড়া অনলাইনেও টিকিট কাটার সুযোগ রয়েছে। তথাপিও পরের দিন সকাল সাড়ে ১০টার টিকিট কনফার্ম করে নিয়েছে।
স্টেশন লাগোয়া একটা হোটেলে রাত কাটিয়েছে গবেষকরা। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে তারা। বুরিয়াতিয়ায় এপ্রিলে সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই সূর্যের আলো ফুটে ওঠে। অন্যদিকে এপ্রিলে সূর্যাস্ত যায় ৮টার মধ্যে। অবশ্য তুষারাচ্ছন্ন পরিবেশ থাকলে ভিন্ন কথা, সূর্যের দেখাও মেলে না তখন। এমনকি মাসখানেকের মধ্যেও সূর্যের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না; অনেক সময় এরচেয়েও বেশি সময় সূর্য নজরে পড়ে না। সেই এক বিচিত্র্য আবহাওয়া সাইবেরিয়া অঞ্চলের।
সকাল সাড়ে ১০টায় তাদের ট্রেন। শয্যাত্যাগ করে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একজন গাইড সঙ্গে নিয়ে বৈকাল পর্বতমালার উদ্দেশে যাত্রা করেছে তারা। গাইড হিসেবে সঙ্গে নিয়েছে বুরিয়াত সম্প্রদায়ের এক তরুণকে। তরুণের নাম ‘মার্জেন লনিয়া’, স্থানীয় বাসিন্দা। বয়স পঁচিশের কোঠায়।
সাইবেরিয়াতে গাইড ছাড়া দুর্গমে যাওয়ার কল্পনাও করা যায় না। যেখানে শহরাঞ্চলেই গাইডের প্রয়োজন হয়, সেখানে দুর্গমের কথা ভাবাই কঠিন। তারা যেখানে যাচ্ছে, সেখানকার তাপমাত্রা এখনো শূন্যের নিচে ১০ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শহর অঞ্চলে এই তাপমাত্রায় ততটা সমস্যা হতো না। এই পরিবেশে সামান্য ভুল মানে মৃত্যুর ঝুঁকি! বিষয়টা জেনেও গবেষকরা বুনো পরিবেশে তাঁবু টানিয়ে মাস দেড়েক কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই থিসিসটা সম্পন্ন করতে পারলে ওরা বেশি বেশি মার্ক অর্জন করতে পারবে।
তাছাড়া মস্কোর নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতারও সুযোগ পাবে। কাজেই জীবন বাজি নিয়ে হলেও ভালো কিছু করে দেখাতে হবে। লনিয়ার প্রথম কাজ হচ্ছে সয়ত সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া। তারপর গবেষকদের সঙ্গে দীর্ঘদিন অবস্থান করা। অর্থাৎ যতদিন পর্যন্ত থিসিসের কাজে গবেষকদের এখানে থাকতে হচ্ছে, ঠিক ততদিনই লনিয়াকে তাদের সঙ্গে থাকতে হবে।
লনিয়ার সঙ্গে হোটেল রিসেপশনের একজন যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছে। লেনদেনের বিষয়টাও মীমাংসা করে দিয়েছে রিসেপশন থেকে। অর্ধেক টাকা অগ্রিম দিতে হয়েছে, বাকিটা ফিরে এসে হোটেলেই জমা দেবে; কারণ লনিয়া পেশাগত দিক থেকে এই হোটেলের সঙ্গেই সম্পৃক্ত।
ইচ্ছে করলেই সমগ্র রাশিয়াজুড়ে যে কেউ গাইড পেশায় নিযুক্ত হতে পারে না। এর জন্য সরকারের পূর্ব অনুমতির প্রয়োজন হয়। তাছাড়াও মার্জিত এবং লেখাপড়া জানা হতে হয় গাইডকে। ট্যুরিজমের উপর লেখাপড়া না থাকলে গাইড হিসেবে কাজ করার অনুমতি দেয় না সরকার। আর বাড়তি কিছু বিষয়েও জ্ঞান রাখতে হয় গাইডদের। বিশেষ করে ঠান্ডাজনিত ফার্স্ট এইড এবং প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার ট্রেনিংও নিতে হয় তাদের।
লনিয়া বুরিয়াত সম্প্রদায়ের হলেও সয়ত ভাষায় কথা বলতে পারদর্শী। এই দুই সম্প্রদায়ের ভাষায় অনেকটাই মিল আছে। ফলে লনিয়ার জন্যেও সুবিধা হচ্ছে দোভাষী হিসেবে কাজ চালিয়ে নেওয়ার। সব মিলিয়ে গবেষকরাও খুশি লনিয়াকে পেয়ে। কারণ থিসিসের কাজে তাকে খুব প্রয়োজন পড়বে। যেহেতু সে সভ্য সমাজের ‘বুরিয়াত’, এমতাবস্থায় তাকেও পর্যবেক্ষণ করা যাবে কাছ থেকেই। বিষয়টা যেন ‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি’ প্রবাদের মতো।
অবশেষে সূর্যাস্তের আগেই তিনজন বৈকাল পর্বতমালার কাছাকাছি পৌঁছল। লনিয়া এখানে কয়েকবার এসেছে, জায়গাটা তার মোটামুটি পরিচিত। তবে পর্বতমালার উপরের দিকে তার যাতায়াত খুবই কম। মালভূমিতে আগে শুধু দুইবার গিয়েছিল লনিয়া। ওখানে বাস করা ‘সয়ত’ সম্প্রদায় সম্পর্কেও লনিয়ার ধারণা খুব বেশি নেই। তারপরেও সে আশ্বস্ত করেছে কোন ধরনের সমস্যা হবে না, ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবে এবং বাসস্থানেরও ব্যবস্থা করতে পারবে। একান্ত না পারলে নিজেরাই তাঁবু খাটিয়ে বাসস্থান গড়বে।
এখন যা করতে হবে, তা হচ্ছে রাতের আঁধার নেমে আসার আগেই নিরাপদে পৌঁছতে হবে। তাই লনিয়ার সাহায্য চাইল গালিব। লনিয়া বলল, ‘স্টেশন থেকে জিপে চড়ে আট-দশ কিলোমিটার সামনে যেতে হবে, তারপর বাকি পথ হেঁটে উপরে উঠতে হবে। পার্বত্য এলাকায় কোন যানবাহনের ব্যবস্থা নেই। তোমরা যদি মনে করো আজকে যাত্রা বিরতি দেবে সেটাও করতে পার, আবার যদি মনে করো উপরে দিকে উঠবে সেটাও তোমাদের ইচ্ছে।’
সোপান জানতে চাইল, ‘উপরে উঠলে কি রাত যাপনের ব্যবস্থা করতে পারবে?’
লনিয়া মাথা নেড়ে বলল, ‘না সম্ভব নয়। তবে ভাগ্য ভালো হলে দু-একটা বুরিয়াত পরিবারের তাঁবুর দেখা পাওয়া যেতে পারে। দেখা পেলে ভাড়ার বিনিময়ে ওদের সঙ্গে রাত যাপন করা যাবে।’
গালিবের প্রশ্ন, ‘বুরিয়াতদের দেখা না পেলে?’
লনিয়ার জবাব, ‘নিজেরাই তাঁবু বানিয়ে ফেলব।’
বিস্মিত হলো সোপান, ‘শেষমেষ ঠান্ডায় মারার বুদ্ধি বের করেছ।’
লনিয়া বলল, ‘যে পরিবেশে যাচ্ছি আমরা, সেখানে কারোর উপর নির্ভর করে যাওয়া ঠিক হবে না। নিজেরাই নিজেদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে যেতে হবে, কারণ এটা সাইবেরিয়া; ঠান্ডার রাজ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরাক্রমশালী জার্মান সেনারা রাশিয়ায় কঠিন ঠান্ডার কবলে পড়ে পরাস্ত হয়েছিল। অথচ জার্মান সেনারাও শীত প্রধান দেশের বাসিন্দা ছিলেন। তাহলে বোঝ প্রশিক্ষিত সেনারাও হিমঠান্ডায় কতটা কাবু হয়েছিলেন। এই সাইবেরিয়া শুধু ঠান্ডার নরকই নয়, রাশিয়ার জন্য আশীর্বাদও। সাইবেরিয়ার বরফের নিচে লুকিয়ে আছে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ।’ চলবে...