যে বয়সকে আমরা কিশোর হিসেবে মনে করছি সেই বয়সের মনোজগত হয় অত্যন্ত আবেগপূর্ণ এবং অস্থির। কিশোর একটি সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। কিশোর প্রজন্ম কোন পথে চলেছে তার উপর পরবর্তী অর্থাৎ যুব সমাজের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। আমাদের বয়সের প্রতিটি ধাপ গুরুত্বপূর্ণ। তার মধ্যে কৈশোর এবং যৌবন সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান কিশোর সমাজ নিয়ে আমরা কিছুটা হতাশার চিত্রই দেখতে পাই। যখন দেখি এসব কিশোর-কিশোরীরা কাউকে খুন করছে অথবা অপরাধে জড়াচ্ছে, মাদক গ্রহণ করছে। খুব কমই আশাব্যঞ্জক খবর পাই। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর মুখটা অপরাধীর না হয়ে হাসি হাসি মুখ থাকছে! অর্থাৎ ভেতরে অপরাধবোধ এবং ভয় কোনোটাই নেই। কেন এমনটা হচ্ছে? একটি সমাজের কিশোরদের একটি অংশ যদি এসব অপরাধে নিমগ্ন থাকে তাহলে ভবিষ্যৎ অবশ্যই দুশ্চিন্তার। রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় দুই বোনকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হন এক কিশোর। খুব সামান্য কারণেই ছেলেটি তার খালাদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। হত্যা করার কারণও অতি তুচ্ছ। সাইকেল কেনার টাকা চুরি করা দেখে ফেলেছিল এবং খালা সেটি কিশোরের পরিবারকে জানিয়ে দিতে চেয়েছিল। এই তো? কিশোর বয়সে এমন ভুলও হয় এবং পিতামাতা শাসনও করেন। তার জন্য খুন? এরকম আরও ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। পত্রিকার পাতা খুললেই এসব সংবাদ চোখে পড়ে। মাঝেমধ্যে আশাব্যঞ্জক সংবাদও পাওয়া যায়। দিনাজপুরের হাকিমপুরের হিলিতে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা পেয়ে তা ফিরিয়ে দিয়েছে দুই কিশোর।
এই হলো প্রকৃত কৈশোরের চিত্র। এমন মানুষ সমাজ আশা করে। যদিও এ সংখ্যা খুব সামান্যই। সত্যি কথা বলতে, বর্তমান সমাজে অপরাধের একটি অংশ সংঘটিত হচ্ছে কিশোরদের দ্বারা। নানাভাবে এরা অপরাধ প্রবণতায় ঝুঁকছে। এর ফলে সমাজের ভারসাম্য এবং শৃঙ্খলা বিনষ্ট হচ্ছে। যখন তাদের হাতে বই থাকার কথা, তাদের লেখাপড়া নিয়ে আলোচনা করার কথা তখন তারা ভাবছে নেতিবাচক কোনো বিষয় নিয়ে অথবা এক দল কিশোর অবলীলায় আরেক দলের ওপর হামলা করছে। কিশোরের হাতে কিশোর নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এরা কেন অপরাধপ্রবণ হচ্ছে এবং এর জন্য পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র কি ভূমিকা পালন করছে সেই প্রশ্ন করা আবশ্যক। ইংরেজি ম্যানারস বা আচরণ একটি বিস্তৃত শব্দ যা পারিবারিক শিক্ষায় লালিত হয়। যেখানে আজ দেশে পরিবার ব্যবস্থাই ভাঙনের সম্মুখীন, সেখানে সেই পরিবারের একটি শিশু কীভাবে বড় হয়ে উঠছে তা দেখার সময়ইবা মানুষের কোথায়? যেহেতু একটি শিশু জন্মের পর থেকেই প্রযুক্তির সংস্রবে বড় হয়ে ওঠে তাই এর থেকে তাকে দূরে রাখা অসম্ভব। সে কীভাবে সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে বা করবে সেই অভ্যাস গড়ে তোলা যায়। আমরা কতজন সেই কাজটা করছি। গেমসের তীব্র নেশা আজ এসব উঠতি বয়সি ছেলেমেয়ের চোখে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তারা গেমস খেলে। সম্প্রতি দেশে যে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে সেসবের অনেকগুলো করছে কিশোর বয়সীরা। সব ধরনের অপরাধেই তারা জড়িয়েছে। যে বয়সে একজন কিশোরের চোখে থাকবে উন্নত জীবনের স্বপ্ন, ভালো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন, দেশকে কিছু দেওয়ার স্বপ্ন ঠিক সেই বয়সেই সে জড়াচ্ছে ভয়ংকর সব অপরাধে। তাদের ভেতর কেন এই অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে? তাদের হাতে মাদক উঠে আসছে কিভাবে? কেন দেশে কিশোর গ্যাং নামের শব্দটি আজ এত বেশি আলোচিত হচ্ছে?
যদি কিশোররা এভাবে বই-খাতা ছেড়ে মাদক, অস্ত্র হাতে তুলে নেয় তাহলে সোনার স্বপ্ন দেখা এই দেশের হাল কে ধরবে? কিশোরদের এই গ্যাং কীভাবে বিস্তার লাভ করছে বা তাদের পেছনে কোন শক্তি আছে সেটা খুঁজে বের করা জরুরি। তাদের বুদ্ধি অপরিণত। তাই তাদের সংশোধন সম্ভব। এই সংশোধন শুরু করতে হবে পরিবার থেকে। কিশোর বয়স মানুষের জীবনে এমন একটা সময় যখন তার মনে বা চিন্তার জগতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এই সময়টা অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই বয়সটাই ভুল করার বয়স। ভুল পথে যাওয়ার বয়স। ভুল বোঝানোর বয়স। আবার ভুল থেকে শিক্ষা নেয়ারও বয়স। এই সময় শিশু বড় হয়ে উঠতে চায় আবার আদরও পেতে চায়। অর্থাৎ এক বিচিত্রতা খেলা করে তার মনে। তারা বড় হয় অ্যাডভেঞ্চারের স্বপ্ন দেখে।
এসব প্রতিটি কিশোরই সম্ভাবনাময়। অথচ আজকাল এসব কিশোররা অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে অপরাধের সঙ্গে। অপরাধের এমন কোনো জগত নেই যেখানে তার বিচরণ নেই। নেশা থেকে শুরু করে খুনের মতো জঘণ্য অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে তারা। তাদের আচরণ বা তাদের চলন দেখলে মনে প্রশ্ন জাগে আমরা কোথায় যাচ্ছি। আমাদের এ কিশোর প্রজন্ম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। যদিও কয়েকটি গ্রুপ বা কয়েকজন কিশোর কিশোরী নিয়ে সামগ্রিক বিচার করা ঠিক না- তবে এদের সংখ্যা বাড়ছে। এর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে যে একসময় আমাদের বড় সংকটে পড়তে হবে না তার নিশ্চয়তা নেই। দেশে কিশোর অপরাধ নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। এদের সংশোধনের উপায় নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। যে ভুল পথে এরা এগিয়ে চলেছে তা যে অন্ধকার তা তাদের মস্তিষ্কে ঢোকাতে হবে। এই কাজটি এই মুহূর্তে করা এতটাও সহজ নয়। কারণ কিশোর গ্যাং নামের বিশ্রী শব্দটি আজ সমাজের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা দ্রুতবেগে মোটরসাইকেল নিয়ে শোডাউন করে, যুক্ত হয় নানা অসামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে এবং একসময় এরা পুরোপুরি পথভ্রষ্ট হয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে।
গত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের নীতি-নৈতিকতা ভুলে এসব কিশোর-কিশোরী তরুণ-তরুণী জড়াচ্ছে অপরাধে। চলতি বছরেও কিশোর অপরাধ ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রায়ই কিশোর গ্যাং নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। কেন এরা মুক্তি খুঁজে ফিরছে ভুল পথে? কেনই বা তারা অপরাধ প্রবণ হচ্ছে? যে পথের না আছে কোনো শুভ সমাপ্তি। যেখানে পদে পদে রয়েছে অনিশ্চয়তা, সেখানে এরা পায় অপার শান্তি। তাদের এই বোধ কেন হলো। কোন নিঃসঙ্গতার জালে পড়ে এসব পথে এরা পা বাড়াল। শিশু-কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা সমাজের জন্য ভয়ংকর। তাদের এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এসব ছেলেদের হাতে থাকার কথা বই। এদের কালচার হবে একাডেমিক। সেখানে এদের হাতে চাপাতি। মুখে নেশার গন্ধ। অথচ নেশা জিনিসটাই এদের বোঝার কথা ছিল না। আজকাল রাস্তাঘাটে তাকালেই চোখে পড়বে এসব কিশোররা দামি দামি মোটরসাইকেল দ্রুতগতিতে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সচরাচর যেসব মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে তাদের অধিকাংশই এসব কিশোর বয়সের ছেলেদের। হয়তো শখ করে বা জিদের বশবর্তী হয়ে তারা বাবা মায়ের কাছ থেকে মোটরসাইকেল কিনে নেয়। তারপর দুর্ঘটনা ঘটে। বাবা মা না চাইলেও সন্তানের কথা চিন্তা করে কিনে দিচ্ছে। কৈশোরের বেপরোয়া গতিকেই সামাল দিতে পারছে না অনেক কিশোর-কিশোরী। তারা গ্রুপ তৈরি করছে। নিজেদের দল তৈরি করছে। তাদের হাতেও অস্ত্র উঠে আসছে। কতশত আধুনিক নামে নিজেদের সজ্জিত করেছে। ভিডিও গেমসে রোমাঞ্চকর সব গেমস খেলছে। সেখানে কাউকে মারছে, গুলি করছে। সেখানেই পরিচয় হচ্ছে ভয়ংকর সব অস্ত্রের সঙ্গে।
পিতা-মাতার শাসন থেকে মুক্ত। শাসনের তোয়াক্কাই করছে না এসব বিপথগামী কিশোর। কেউ এসএসসি, কেউ এইচএসসি আবার কেউ তার থেকে উপর ক্লাসে পড়ে। এরা কেন এত হিংস্র হয়ে পড়েছে। কিসের অভাব ওদের। শুধু আদনান হত্যাকাণ্ডই নয়। কিশোরদের অপরাধের জগতে জড়িয়ে পড়া, নেশার দিকে ঝুঁকে পড়া জাতির জন্য ভয়ানক বিপজ্জনক। বর্তমান তরুণ-তরুণীদের একটি অংশ আজ দিধাগ্রস্ত। এরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। একদিকে মা-বাবার ব্যস্ততার কারণে সময় না দেওয়া অন্যদিকে হাতের নাগালে মোবাইল, ইন্টারনেটসহ নানা আধুনিক সরঞ্জাম। সাময়িক মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি খুঁজতে এরা প্রথমে যন্ত্রের আশ্রয়ে যাচ্ছে। দিনরাত মোবাইলের পর্দায় চোখ বুজে থাকা এদের নেশা হয়ে গেছে। বেশিরভাগ সময় এদের কাটছে যন্ত্রের সঙ্গে। ফেনসিডিল, হেরোইন ছাড়িয়ে আজ ইয়াবার মতো অতি মারাত্মক এবং ধ্বংসকারী মাদকদ্রব্যে আসক্ত হয়ে পড়ছে যুবসমাজের একটি অংশ। এছাড়া আধুনিক যুগের নামে ইন্টারনেটের অপব্যবহার করছে। পর্নোগ্রাফিতে মজছে তারা।
জ্ঞানের আলো যাদের মধ্য দিয়ে বিকশিত হবে তারাই যদি অন্ধকারে ডুবে থাকে তাহলে কোনো দিন কি ভোরের আলো ফুটবে? একটি দেশের স্বপ্ন লুকিয়ে থাকে এসব কিশোরের মধ্যে। এরাই যৌবনে পা রেখে দেশকে নেতৃত্ব দেবে। এদের ফেরাতে হবে। এখনই যদি হাল না ধরতে পারি তাহলে একসময় দেশের মহাসর্বনাশ হবে। এদের থামাতে হবে। আর এর প্রধান দায়িত্ব পরিবারের ওপরই বর্তায়। আমার সন্তান কোথায় যায়, কার সঙ্গে মিশে বা তার অবসর সময় কীভাবে কাটায় তার দিকে গভীর পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তাকে দামি মোটরসাইকেল কিনে দেওয়ার আগে ভাবুন সেটি তার প্রয়োজন কি না। তার হাতে দামি মোবাইল ফোন কিনে দিয়েই দায়িত্ব শেষ না করে সেটি সে কীভাবে ব্যবহার করছে তাও পর্যবেক্ষণ করবেন।