৬ দশকেও আলোর মুখ দেখেনি দেশে আবিষ্কৃত প্রথম লৌহ খনি। রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার শানেরহাট ইউনিয়নের ভেলামারি পাথারে ১৯৬৪ সালে এই লোহার খনির অস্তিত্ব নিশ্চিত করে তৎকালীন পাকিস্তান খনিজ সম্পদ বিভাগ। ১৯৯৯ সালে পুনরায় খনন শুরু করেছিল জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ (জিএসবি)।
সুদীর্ঘ ৬০ বছর আগে এই লৌহ খনিটির প্রথম সন্ধান পাওয়া গেলেও আজও উত্তোলনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সূত্র জানায়, এ বছর ওই স্থানে আবারও ড্রিলিং করে কূপ খনন করা হবে। এদিকে পীরগঞ্জের ভেলামারি খনি থেকে লোহা উত্তোলনের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ-(জিএসবি) ও পেট্রোবাংলা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার শানেরহাট ও মিঠিপুর ইউনিয়নের মাঝামাঝি বিশাল একটি এলাকার নাম ভেলামারি পাথার। এখানেই আবিষ্কৃত হয়েছে দেশের প্রথম বিশ্বমানের লৌহ খনির। ওই সময়ে খনি এলাকা চিহ্নিত করে সেই জমিতে কংক্রিটের ঢালাই করে রাখা হয় অনুসন্ধান করা চারটি কূপের মুখ। ৬০ বছর ধরে খনিমুখে কংক্রিটের ঢালাইয়ের ভিতর আটকে আছে মূল্যবান এই সম্পদ।
জেসবি ও পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, ১৯৬৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধের পর স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তৎকালীন পাকিস্তান খনিজসম্পদ বিভাগের একদল বিশেষজ্ঞ বিমান ও গাড়িবহর নিয়ে এই ভেলামারি পাথারে আসে। প্রায় ছয় বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই পাথারে তারা লৌহ খনির অবস্থান নিশ্চিত করতে এ্যারোমেটিক সার্ভে পরিচালনা করে। উড়োজাহাজের নিচে একটি বিশাল শক্তিশালী চুম্বক ঝুলিয়ে দেন। এরপর উড়োজাহাজটি ট্রি লেবেলে পাথারের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে থাকে।
একপর্যায়ে উড়োজাহাজে ঝুলন্ত চুম্বকটি ভেলামারি পাথারে ছোট পাহাড়পুর গ্রামের আবুল ফজল ও আবদুল ছাত্তার নামে দুই ব্যক্তির মালিকানাধীন জমির ওপর এসে আকর্ষিত হয়। এই আকর্ষণ উড়োজাহাজটিকে বারবার মাটির দিকে টেনে নিচে নামাতে চেষ্টা করে। পরে মাসাধিককাল ব্যাপী বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তৎকালীন খনিজ বিজ্ঞানীরা এখানে লোহার খনির অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হন। পরে উৎস হিসেবে ওই জমির ওপর কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে চলে যান।
সূত্রমতে, পরের বছর পাকিস্তান খনিজসম্পদ বিভাগ চিহ্নিত স্থানে খনন কাজ শুরু করে। প্রায় আট মাস ধরে তারা ভেলামারি এলাকার পাশের কেশবপুর, ছোট পাহাড়পুর, প্রথমডাঙ্গা, পবনপাড়া, সদরা কুতুবপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অসংখ্য স্থানে পাইপ বসিয়ে লোহার খনির সন্ধান করে নিশ্চিত হন। অনুসন্ধানের সময় পাইপের ভেতর দিয়ে মাটির গভীরে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বোমার বিস্ফোরণে ওই এলাকার অনেক মাটির কুয়া ভেঙে যায় সেসময়। দ্বিতীয় দফায় পাইপের মাধ্যমে জরিপ কাজ সম্পন্ন করা হয়। ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে পাকিস্তান খনিজ সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তাসহ একদল বিদেশি খনিজ বিশেষজ্ঞ রংপুরে আসেন। তারা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির বিশাল বহর ও পরিবার পরিজনসহ স্থানীয় পানবাজার উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অস্থায়ীভাবে ক্যাম্প করে লোহার উপাদান উত্তোলন করে। মাটির ৯শ’ ফুট নীচ থেকে ২২ হাজার ফুট পর্যন্ত পাইপ বসিয়ে লোহার উন্নতমানের স্তরের সন্ধান পায়। এর বিস্তৃতি প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার।
টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে ব্যাপক অনুসন্ধান শেষ করে ভেলামারিতে অনুসন্ধান কূপের পৃথক চারটি মূল পাইপের উৎসমুখে কংক্রিটের ঢালাইয়ের দিয়ে বন্ধ করে ক্যাম্প গুটিয়ে চলে যান। এ সময় তারা বলেন লৌহ অপরিপক্ব অবস্থায় রয়েছে। ধারণা করেন আগামী ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যেই এটি উত্তোলন যোগ্য হতে পারে। সেই হিসেবে ৪২ বছর আগে লোহা খনিটি পরিপক্কতা লাভ করেছে। যা বর্তমানে উত্তোলনযোগ্য।
বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর দ্বিতীয়বারের মতো ১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভেলামারি পাথারে লোহার খনির অনুসন্ধান কাজ শুরু করেন। কিন্তু তারা পূর্বে আবিষ্কৃত লৌহ খনির উৎসমুখ ভেলামারি হতে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে বড় পাহাড়পুর গ্রামের পূর্ব প্রান্তে পরীক্ষামূলক খনন করে কোনো রিপোর্ট প্রকাশ না করেই চলে যান। ওই রিপোর্ট পরে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করাও হয়নি। ২০২৩ সালের শেষের দিকে খনিটির মূল উৎস থেকে প্রায় ৪ কি.মি. দূরে কাশিমপুর গ্রামে ড্রিলিংয়ের মাধ্যমে কূপ খনন করে। তবে সেখানে কি পাওয়া গেছে তা প্রকাশ করেনি জেএসবি।
জিএসবি সূত্র নিশ্চিত করেছে, সেখানে অনুসন্ধান চালিয়ে উন্নতমানের আয়রন কোর (লোহা আকরিক) পাওয়া গেছে। কিন্তু সেখানে আয়রন কোরের রিজার্ভ কম হওয়ায় লৌহ উত্তোলনের সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি জিএসবি। কারণ হিসেবে বলেছেন, রিজার্ভের পরিমাণ ইকোনমিক্যালি ভায়াবোল না হওয়ায় খনি থেকে লৌহ উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে না। যে পরিমাণ খরচ হবে তা রিজার্ভ দিয়ে পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না বলেও উল্লেখ করেছেন তারা। লৌহ খনির অবস্থান নিশ্চিত করে অনুসন্ধান চললেও উত্তোলনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি তারা। লৌহ খনিটি আবিষ্কারের পর এখন প্রায় ৬০ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, পীরগঞ্জের ভেলামারি পাথারের এই লোহার খনিটি এখন পরিপক্ব হয়েছে। অথচ পেট্রোবাংলা ড্রিলিং ও কূপ খনন করে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো হয়েছে। চলতি বছরেও কূপ খনন করবে জিএসবি।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরুদ্দোজা মিয়া বলেন, বাংলাদেশে প্রথম লৌহসহ আরও কিছু মিনারেল এর ট্রেস পাওয়া গেছে রংপুরের পীরগঞ্জে। এখনও মাইনিং পর্যায়ে যাওয়ার মত যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত নাই। ভেলামারী পাথারে আরও একটি ড্রিলিংয়ের পরিকল্পনা রয়েছে পেট্রো বাংলার সাবেক পরিচালক মকবুল-ই-এলাহী চৌধুরী মশগুল বলেন, ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম লৌহ খনি আবিষ্কৃত হয় পীরগঞ্জে, যা পেট্রো বাংলায় পীরগঞ্জ-১ ফাইল নামে সংরক্ষিত আছে। এটাই বাংলাদেশের প্রথম লোহার খনি।