সময়ের পরিক্রমায় কমছে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা। এতে হারাতে বসেছে হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। নববর্ষ উৎসব কেন্দ্রিক কিছুটা চাহিদা, দইয়ের নাড়ি ও সাড়ার চাহিদা থাকলেও সারা বছর তেমন বিক্রি হয় না মাটির তৈরি সামগ্রী। এরমাঝে কাঁচামালের উচ্চমূল্যসহ নানা প্রতিকূলতায় কুমারদের অবস্থা সংকটাপন্ন। শুধু পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এ পেশাকে আঁকড়ে আছেন তারা। সরেজমিনে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার আড়মবাড়িয়া পালপাড়ায় কুমারদের সঙ্গে কথা হলে তারা এ চিত্র তুলে ধরেন। পালপাড়ার বাসিন্দাদের মতে, আগের মতো এখন মাটির জিনিসের তেমন কদর নেই। সারা বছর টানাপোড়েনের মধ্যে চলে তাদের সংসার। পূর্বপুরুষের কাছ থেকে শেখা কাজের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শিকড়ের টানে এই পেশা তারা ইচ্ছে হলেও ছাড়তে পারেন না। ঈশ্বরদী উপজেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আরাম বাড়িয়া কুমারপাড়ার মৃৎশিল্পের খ্যাতি রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ পথচলায় এই খ্যাতিও এখানকার শিল্পীদের জীবনমান বদলাতে পারেনি। দারিদ্রতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে তারা পূর্বপুরুষের পেশাকে এখনও আঁকড়ে রেখেছেন।
মৃৎশিল্পের জন্য প্রয়োজন পরিষ্কার এঁটেল মাটি। কিন্তু এখন মাটি পাওয়া সহজ নয়। একসময় পাশের পদ্মা নদী থেকে এঁটেল মাটি তুলে এনে এ শিল্পের কাজ করতেন তারা। বর্তমানে মৃৎশিল্পের প্রধান উপকরণ মাটি নিয়ে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। অন্য জায়গা থেকে মাটি কিনে আনতে হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা সাধন চন্দ্র পাল বলেন, বর্তমানে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে রাজশাহীর বাঘার বলিহারপুর থেকে এক টলি মাটি কিনতে দাম নেয় এক হাজার টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকা। এছাড়া বেড়েছে মাটি সরবরাহ ও জ্বালানি খড়িসহ আনুষঙ্গিক ব্যয়।
জানা যায়, একসময় মাটির তৈরি জিনিসপত্রের বিকল্প ছিল না। তবে আধুনিকতার ছোঁয়া ও মানুষের রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মাটির তৈরি সামগ্রীর স্থান দখলে নিয়েছে প্লাস্টিক, সিরামিক, মেলামাইন, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের নানা সামগ্রী। বাজারে চাহিদার স্বল্পতা, কাঁচামালের চড়া মূল্য ও পুঁজির অভাবে টিকতে না পেরে সংকটে রয়েছেন মৃৎশিল্পীরা। সেই সঙ্গে কুমারদের নতুন প্রজন্ম এখন ভিড়তে শুরু করেছেন অন্য পেশায়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এই শিল্প বাঁচতে পারে বলে মত স্থানীয়দের। কুমারপাড়ার মিতা রানি পাল বলেন, আমার বয়স প্রায় ৬০ ছুঁইছুঁই।
বিয়ের পর থেকে এ পেশার সঙ্গে আমি জড়িত। আগে মাটির সামগ্রীর প্রচুর চাহিদা থাকলেও এখন আর তেমন নেই। এই শিল্পের সঙ্গে আমাদের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। কুমারপাড়ার ৬৫ বছর বয়সী পুষ্প রাণী পাল বলেন, মৃৎশিল্প আমাদের জীবিকার প্রধান উৎস। আমাদের আর কোনো আয়ের উৎস নেই। আমরা যে চাষাবাদ করে খাবো, সেই জমিটুকুও নেই। আমার মা এই পেশায় জড়িত ছিলেন। আমার শাশুড়ির পরিবারও এ পেশায় জড়িত। ছোটবেলা থেকে আমরাও জড়িয়ে পড়েছি এই শিল্পের সঙ্গে। মৃৎশিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ এঁটেল মাটি, রং, যন্ত্রপাতি ও জ্বালানি এখন ব্যয়বহুল। এসব প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই আমরা এখন দইয়ের মালশা বা খুটি তৈরি করে বিক্রি করছি। এখানকার দইয়ের খুঁটির চাহিদা বেশি। এটা শুধু ঈশ্বরদীতেই নয় এর বাহিরে আশেপাশে উপজেলা থেকেও দইয়ের নাড়ি ও সাড়া কিনে নিয়ে যায়।