সোনালি শস্য সয়াবিনের উর্বর ভূমি সয়াল্যান্ড খ্যাত লক্ষ্মীপুর বরাবরই দেশব্যাপী চর্চিত এক নাম। এমন চর্চার হৃদয়গ্রাহী প্রতিচ্ছবির একটি জেলার রায়পুর উপজেলায় অবস্থিত উপজেলা প্রশাসন আর্ট স্কুল। স্কেচবুকে পেনসিলের কারুকাজ কিংবা জলরঙে আঁকা কাল্পনিক অস্তিত্বের কোনো ছবি- মুগ্ধ নয়নে দেখে জেলাবাসী। আনন্দঘন একটি দিনের পরশ কেমন কাটতে পারে আর্ট স্কুলটির আঙিনায় সেই আলাপনের গল্প তুলে ধরা হয়েছে এখানে। দিনের শুরু হয়েছিল শীতে আচ্ছাদিত প্রকৃতির নিস্তব্ধতায়। শিশির ভেজা সকালের খানিক পরে মনের স্পৃহা নিয়ে হাজির আঁকিবুকির রাজ্যে। রায়পুর থানা প্রাচীরের পূর্ব দিকের রাস্তা ধরে এক মিনিট হাঁটলেই নাগাল মেলে স্কুলটির প্রধান ফটকের। চার শিক্ষকের একজন আরিফা সুলতানা পূর্ব পরিচিত হওয়ায় প্রবেশে ছিল না কোনো সংশয়। ফটক থেকে পা মেলতেই চোখে পড়ে বড় হলরুমটিতে শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা। একেকজন আপন মনে আঁকছে নিজ নিজ ভাবনার প্রতিচ্ছবি। তাদের একজন বছর দশ বয়সী শাওন দাস। নতুন অতিথি আসায় কিছুটা মনোযোগ হারায় সে। সামনে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো তার অর্ধ আঁকা গ্রামবাংলার দৃশ্য। ফাতেহা বিনতে সোহেল, তীর্থ পাল, তনুলতা নাথ, তাবাচ্ছুম ইহা নামের কয়েকজন শিক্ষার্থী তখনো আঁকছে গভীর মনোযোগ নিয়ে। বেলা গিয়ে ঠেকেছে তখন সাড়ে এগারোটার কাছাকাছি। চট্টগ্রাম থেকে আসা দুজন শিক্ষকের সঙ্গে এর মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে পরিচয় পর্ব। স্কুলটির মোট শিক্ষক চারজন। ঘুরে দেখার সুচনা পর্যায়ে হঠাৎ চোখ গেল ভেতরকার দেয়ালের দিকে। ভাষা শহীদ, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, গ্রাম বাংলা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বিখ্যাত চিত্রকর্ম মোনালিসাসহ বেশ কিছু ছবির ঠাঁই হয়েছে দেয়ালগুলোয়। আলাপচারিতায় আরিফা জানান- আর্ট স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পেছনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। দেশে এখন পর্যন্ত স্থাপিত আর্ট স্কুলগুলো একটির অবস্থান লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে। এটি তৈরির প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন উপজেলাটির বিদায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অঞ্জন দাশ।
কথায় কথায় জানা যায়, তিনি চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী। প্রশাসন ক্যাডারে আসার পরেও আঁকড়েছিলেন নিজের শিল্পী স্বভাব। অঞ্জন দাশের পরেই স্কুলটির উদ্যোক্তা কাতারে আসে একই উপজেলার সাবেক আরেক কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাসেল ইকবালের নাম। শিল্পী মনের মর্যাদা ও চিত্রশিল্পের প্রসারে স্কুলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় থাকা স্থানীয় সংসদ সদস্য নূরউদ্দিন চৌধুরী নয়নের নামও রয়েছে আঁকিবুঁকির এই রাজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে। আরিফা আরো জানান, ২০২৩ সালের অক্টোবরে স্কুলটির উদ্বোধন করেছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপি। একতলা বিশিষ্ট ভবনটি উদ্বোধনের সপ্তাহ পরেই এর দ্বিতীয় তলার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন একাদশ সংসদের শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি। শিক্ষিকা আরিফার সাথে কথার ফাঁকে আরো জানা যায়, উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমা বিনতে আমিন যোগদান করার পর তিনি গ্রহণ করেন প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার মূখ্য দায়িত্ব। এখন এটির মুল দায়িত্ব রয়েছে বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইমরান খাঁনের কাঁধে। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন স্থানীয় বিশিষ্ট মিডিয়া মুখ শংকর মজুমদার। আঁকাআঁকির ভূবণ রাজ্যে কথা হয় শিক্ষার্থী ফাতেহা বিনতে সোহেলের সঙ্গে। সে জানায়, আর্ট শেখার জন্য বাসায় বলা মাত্রই রাজি হয় সে। তার আগ্রহ দেখে পরিবারের সবাই সিদ্ধান্ত নেয় উপজেলা প্রশাসন আর্ট স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে। যেই কথা সেই কাজ। ভর্তির পর নিয়ম করে সপ্তাহে স্কুলের নির্ধারিত দুদিন-শুক্র ও শনিবারে হাজির হয় সে। খুব একটা জরুরত না থাকলে নির্ধারিত দিনগুলোতে সবার আগে ফাতেহা উপস্থিত হয় প্রতিষ্ঠানটিতে। তাবাচ্ছুম ইহা নামের আরেক খুদে জানায়, আঁকা নাকি তার খুব প্রিয়। সে প্রকৃতি ও পরিবেশের মনোরম দৃশ্য আঁকতে খুবই ভালোবাসে। প্রিয় দৃশ্যপটের কথা উঠতেই সে বলে ওঠে- গ্রামীণ পরিবেশ আর নদীর দৃশ্য তার খুবই প্রিয়। নদীর পাড়ে একটি বটগাছও নাকি বাড়াবে দৃশ্যপটের সৌন্দর্য- এ কথাও অকপটে জানায় শিশুটি। তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, এ যেন লক্ষ্মীপুরের চিত্রাঙ্গনে লক্ষ্মীরুপের আনাগোনা। শিশুদের মনোভাবনার হৃদয় ছোঁয়া কথা শুনতে শুনতে চোখে পড়লো একজন নিজ জন্ম জনপদ লক্ষ্মীপুরের চিরায়ত লক্ষ্মীরূপ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে সর্বোচ্চ দিয়ে। দীর্ঘ সময়ে সার্বিক চিত্র অবলোকন করে হৃদয় যেন বলে উঠলো, এই খুদেরা-ই লক্ষ্মী রুপের অলংকার। গল্পে গল্পে পেরিয়ে যায় দীর্ঘ সময়। বেলা সাড়ে বারোটা ছুঁইছুঁই। শাওন শেষ করেছে নিজের গ্রামীণ দৃশ্যপটের কাজ। নতুন শিক্ষার্থী হওয়ায় শুধু পেরেছে পেন্সিল স্কেচ সমাপ্ত করতে। চিত্রে রঙকর্মে সে পারদর্শী না হলেও ইচ্ছে শক্তি তার প্রবল। মুলত স্কুলটিতে শিক্ষার্থীরা শিখছে চিত্রকর্ম। আঁকছে- গুণিজন, গ্রামবাংলা, চিরায়ত বাংলাদেশের রুপচিত্র। সাবলীল ভাবে আঁকার হাত খুব অল্প হলেও শেখার হাত যেন তাদের ঢের বেশি। অধিক ইচ্ছা শক্তিই হয়তো করবে নবাগত অঙ্কুরময় চিত্রশিল্পীদের সফল। দেশের বর্তমান কারিকুলামের শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ের জটিল সমীকরণ সহজে উপস্থাপনেও কয়েক ধাপ এগিয়ে প্রতিষ্ঠানটি। মাস প্রতি তিনশো টাকা বেতন ও নামমাত্র দুশো টাকায় রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ। ভর্তির ক্ষেত্রে বয়সসীমা কিছুটা দৃশ্যমান হলেও স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারা পাচ্ছে প্রতিভা বিকাশের অনন্য সুযোগ। বেসরকারি আঙ্গিকে চলা আঁকিবুঁকির এই রাজ্য হয়তো নিকট সময়ে পাবে সরকারি অর্থায়ন- এমনটি ভাবতে ভাবতে বিদায় জানালাম লক্ষ্মীপুরের লক্ষ্মীরূপের শোভাবর্ধনে ভূমিকা রাখা খুদে অঙ্কুরগুলোকে। রায়পুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইমরান খান জানান, বাংলাদেশে কয়েকটি আর্ট স্কুলের মধ্যে এটি একটি, উপজেলা প্রশাসন থেকে সব সময় এর দেখভাল করা হয়, উদ্বোধনের পরে শুধু আর্ট শিখানো দিয়ে শুরু করা হয়, এখন এখানে গান, স্পকিং ক্লাস, বাদ্যযন্ত্র বাজানোসহ শিখানো হয়, আমাদের প্লান আছে আন্তর্জাতিক মানের আর্ট স্কুল তৈরি করা।