প্রতি বছর ব্যাপক আলু উৎপাদন হয় জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলায়। চলতি মৌসুমে এবার এই উপজেলায় প্রায় ৬৮০ হেক্টর বেশি জমিতে আলু উৎপাদন হয়েছে। এবার আলু উত্তোলন শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত মাঠেই কৃষকের উৎপাদিত অর্ধেক আলু রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন কৃষক ও কৃষি অফিস। সেই মোতাবেক মোট উৎপাদনের অর্ধেক আলু খেতে থাকা অবস্থাতেই হিমাগারে সংরক্ষণের বুকিং নেয়া সমাপ্ত ঘোষণা করেছে হিমাগারগুলো। আলুর বুকিং কার্যক্রম শেষ হওয়ায় খাবার ও বীজ আলু সংরক্ষণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ও বিপাকে পড়েছেন আলু চাষিরা। প্রতিদিন আলুর বুকিং নিতে হিমাগারগুলোতে ভীড় করতে দেখা গেছে আলু চাষিদের। বুকিং না পেয়ে এক বুক হতাশা নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন তারা।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত বছর এই উপজেলায় প্রায় ৫ হাজার ৯২০ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদন হয়েছিল। এই বছর আলু উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ৬৮০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ বেশি হয়েছে। এবারে মোট উৎপাদিত আলুর পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত কৃষকের প্রায় ২ হাজার ৬০০ হেক্টর জমির আলু মাঠেই অনুত্তোলিত অবস্থায় আছে। স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে, এই উপজেলায় আলু সংরক্ষণের জন্য দুটি হিমাগার রয়েছে। একটি গোপীনাথপুর ইউনিয়নের গোপীনাথপুর হিমাগার লিমিটেড এবং অপরটি তিলকপুর ইউনিয়নের দীনা কোল্ড ষ্টোরেজ লিমিটেড। হিমাগার দুটি এরই মধ্যে তাদের আলু বুকিং কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করছে। আলু বুকিং দিতে না পেরে ফিরে যেতে হচ্ছে আলু চাষিদের। এতে উৎপাদিত আলু নিয়ে দুশ্চিন্তায় ও বিপাকে পড়েছেন তারা। জানা গেছে, দুটি হিমাগারেরই ধারণ ক্ষমতা ১ লাখ ২০ হাজার বস্তা। মেট্রিক টন হিসেবে দুটি হিমাগার মিলিয়ে মোট ধারণ ক্ষমতা প্রায় ১৪ হাজার মেট্রিক টন। যা মোট উৎপাদনের সাড়ে ৯ শতাংশ।
দুটি হিমাগারেই আলু বুকিং কার্যক্রম শুরু ও ঘোষণার পর থেকেই এই উপজেলার পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী উপজেলার এবং বগুড়া ও নওগাঁ জেলার কৃষক ও ব্যবসায়ীরা আলু বুকিংয়ের জন্য নগদ টাকা দিয়ে বুকিং দিয়ে গেছেন। এতে অনেকাংশেই বঞ্চিত হয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। ফলে এই উপজেলার মাঠে রয়ে যাওয়া আলু চাষিরা সময় মতো বুকিং দিতে না পারায় আলু সংরক্ষণ নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। স্থানীয় বাজার গুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকারভেদে পাইকারি দামে কার্ডিনাল আলু ৫৫০ থেকে ৫৭০ টাকায়, ডায়মন্ড আলু ৫০০ থেকে ৫২০ টাকায়, স্টিক আলু ৪৭০ থেকে ৪৮০ টাকায় ও দেশি আলু ৭০০ টাকা পর্যন্ত বাজারে বিক্রয় করছেন কৃষকরা। এদিকে কৃষকদের প্রতিমণ আলু উৎপাদনে খরচ পড়েছে প্রায় সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
হিমাগারে খাবার আলু ও বীজ আলু সংরক্ষণ করতে না পারলে আরও লোকসান গুণতে হবে এমনটি দাবি করছেন স্থানীয় কৃষকরা। উপজেলার আলীমামুদপুর গ্রামের কৃষক তোফাজ্জল মণ্ডল বলেন, গোপীনাথপুর হিমাগার লিমিটেড আমার গ্রামেই অবস্থিত। এ বছর আমি ৮ বিঘা আলু চাষ করেছি। এখন পর্যন্ত ৩ বিঘা জমির আলু তুলেছি, বাকিটা মাঠেই আছে। আলু বুকিং দিতে এসে শুনি বুকিং নেয়া শেষ। অল্প পরিমাণ খাবার ও বীজ আলু রাখতে পারলেও আমরা উপকৃত হবো। গোপীনাথপুর হিমাগারের প্রধান ফটকে দাঁড়িয়ে থাকা মামুদপুর গ্রামের আরেক কৃষক অভিযোগ করে বলেন, আমরা অল্প করে আলু রাখবো, সেই সুযোগও পাচ্ছি না। অনেকেই এসে ঘুরে যাচ্ছেন, আবার অনেকেই শেষ ঘোষণার পরেও বুকিং পাচ্ছেন। এবার আলু ব্যবসায়ীরা সব বুকিং নিয়ে নিছে। আমরা স্থানীয়রা অল্প করে হলেও কী বুকিং পাব না? উপজেলার কানুপুর গ্রামের আলু ব্যবসায়ী শফিউল ইসলাম বলেন, আমি গত কয়েক বছর থেকে আলুর ব্যবসা করছি। গত বছর আলুতে অনেক ভালো লাভ হয়েছে। তাই এবছর আমার নামে গোপীনাথপুর হিমাগারে ১ হাজার ৫০০ বস্তা আলুর বুকিং দিয়েছি। আমার নামে বুকিং হলেও আমার সঙ্গে কয়েকজন আলু ব্যবসায়ী শেয়ার আছে। গোপীনাথপুর হিমাগার লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) রবিউল ইসলাম বলেন, আমাদের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী এবারের বুকিং নিয়েছি। আমরা এ বছরের বুকিং কার্যক্রম শেষ করেছি। আমাদের কাছে যারা এসেছিল (কৃষক, ব্যবসায়ী) প্রত্যেকেরই বুকিং নেয়া হয়েছে। স্থানীয়দের জন্য কিছু বুকিং হাতে রেখে, তাদের ভোটার আইডি কার্ড জমা নেয়া হয়েছে। এর পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার বস্তা। উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নের দীনা কোল্ড ষ্টোরেজের ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) সুপন বড়ুয়ার ভাষ্য, আমরা এই বছরে কৃষকদের অগ্রাধিকার দিয়ে আলুর বুকিং নিয়েছি। বর্তমানে ব্যবসায়ীদের বুকিং নিচ্ছি। বাজারে আলুর দাম কম থাকায় অন্যান্য বছরের তুলনায় এই বছর আলু সংরক্ষণের জন্য কৃষকদের চাহিদা প্রায় ৪ গুণ বেশি। তবে আমরা হিমাগারের নিকটবর্তী এলাকার কৃষকদের প্রাধান্য দিয়ে বুকিং নিয়েছি। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরান হোসেন জানান, এ বছর বীজ আলু বেশি দামে কেনায় ও বাজারে আলুর কাঙ্ক্ষিত দাম থাকায় কৃষকরা আলু সংরক্ষণে বেশি ঝুঁকছেন। এই কারণেই হয়তো হিমাগারগুলোতে সমস্যা হচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মনজুরুল আলম বলেন, গত বছরের তুলনায় এই বছর উপজেলায় আলু বেশি চাষ হয়েছে। তাই আলু সংরক্ষণে কৃষকদের মধ্যে বাড়তি চাহিদা রয়েছে। কৃষকদের অগ্রাধীকার দেয়ার বিষয়ে হিমাগার ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে।