ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

প্রকৃতির সৌন্দর্যে দুঃখের বসত

প্রকৃতির সৌন্দর্যে দুঃখের বসত

লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার মেঘনা নদীর বুকে জেগে থাকা চারটি চরগ্রাম- হাকিম আলি, ছৈয়াল বাজার, কানিবগার চর ও কাজী গ্রাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার ঐশ্বর্য নিয়ে থাকা এসব গ্রামের মানুষ বেঁচে আছেন কঠিন বাস্তবতার মধ্যে।

প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষের বসবাস এই চরগুলোতে। কিন্তু বছরের পর বছর তারা বঞ্চিত স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নিরাপদ যোগাযোগের মৌলিক সুবিধা থেকে। চরাঞ্চলের সবচেয়ে ভয়াবহ সমস্যাটি হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবার অভাব। একটি কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত নেই। সামান্য অসুখ-বিসুখেও রোগীদের নদীপাড়ি দিয়ে শহরে যেতে হয়। প্রসববেদনায় নারীরা নৌকায়, মাঝনদীতে সন্তানের জন্ম দেন- এটা যেন এখানে নিয়মিত ঘটনা।

স্থানীয় গৃহবধূ রাহেলা খাতুন বলেন, আমাদের গ্রামে হাসপাতাল নেই। প্রসবের সময় মা ও শিশুর জীবন ঝুঁকিতে পড়ে। নদী পার হয়ে হাসপাতালে যাওয়া আমাদের জন্য এক বিশাল যুদ্ধ। রায়পুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান ডাক্তার বাহারুল আলম বলেন, এই চরাঞ্চলে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি না থাকায় আমরা কমিউনিটি ক্লিনিক করতে পারছি না। সরকারি জমি বরাদ্দ না হলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো কঠিন।

চরগুলোতে নেই কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০১১ সালে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু হলেও লোকবল ও অর্থের অভাবে টেকেনি। বর্তমানে দুটি মাদ্রাসাই শিক্ষার একমাত্র আশ্রয়। ফলে অধিকাংশ শিশুই প্রাথমিকের পর আর এগোতে পারে না।

স্থানীয় কৃষক আনোয়ার হোসেন বলেন, স্কুল থাকলেও শিক্ষক বা উপকরণের অভাবে তা টিকে না। নদীর এপার-ওপার করে পড়াশোনা চালানো সম্ভব নয় সব পরিবারের জন্য। তবে সমস্যা শুধু অভাবেই নয়, আছে সম্ভাবনার গল্পও। লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সয়াবিন আবাদ হয় এই চারটি চরে। বছরে তিনবার ফসল ফলান কৃষকরা- সয়াবিন, তিল, ডাল, ধানসহ নানা ফসল।

কৃষক মতিউর রহমান বলেন, আমার জমিতে বছরে তিনবার ফসল হয়। সয়াবিন ভালো হয়; কিন্তু শহরে নিতে খরচ পড়ে বেশি। সরকার যদি রাস্তাঘাট ঠিক করে দিত, আমরা আরও লাভ করতে পারতাম।

রাজস্ব আসে চর থেকে, কিন্তু সুফল মেলে না : উৎপাদনে সফল হলেও চরাঞ্চলের কৃষকরা সেই শ্রমের ন্যায্য প্রতিফল পান না। রায়পুরের এই চরগুলো থেকে সরকার প্রতিবছর কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় করলেও, তার সামান্য অংশও এখানকার অবকাঠামো বা কৃষকের জন্য ব্যয় হয় না। চর কাজি গ্রামের কৃষক আবু তাহের বলেন, সরকার আমাদের কাছ থেকে নানা ফি আর কর নেয়; কিন্তু আমাদের জন্য কোনো রাস্তাঘাট করে না। মাঠে ফসল ফলাই; কিন্তু বাজারে নিতে খরচ পড়ে বেশি। লাভ তো দূরের কথা, মাঝে মাঝে খরচই উঠে না।

স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি জানান- সরকার এই চারটি চর থেকেই কোটি কোটি টাকার কৃষিজ পণ্যের রাজস্ব পায়। কিন্তু এখানে কোনো সেতু, রাস্তা বা সংরক্ষণাগার নেই।

চরাঞ্চলের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সংযোগের জন্য একটি ব্রিজ খুবই জরুরি। তা না হলে কৃষিপণ্য পরিবহন, চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য নৌকাই একমাত্র ভরসা থেকে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদনের ভিত্তিতে রাজস্বের ন্যায্য ব্যবহার নিশ্চিত না হলে কৃষকরা উৎসাহ হারাবে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বাড়বে। বর্ষায় পুরো গ্রামগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কাঁচা রাস্তাগুলো নষ্ট হয়ে যায়, মানুষ নৌকা ছাড়া চলতে পারে না।

শিক্ষার্থী মাহিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমি লক্ষ্মীপুর খাশের হাট কলেজে পড়ি। যাতায়াত সুবিধা না থাকায় কষ্ট করে খাশের হাটেই থাকি। নদীবেষ্টিত এই জনপদে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝেও এখানকার মানুষের যন্ত্রণার জীবন দেখে কষ্ট লাগে।

রায়পুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এম আর সুমন বলেন, চরাঞ্চলের মানুষ জীবনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে তাদের বেঁচে থাকার লড়াই চলছে নীরবে। উন্নয়নের আলো এখানে পৌঁছানো এখন সময়ের দাবি। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ একত্রে এগিয়ে এলে মেঘনার বুকের এই জনপদও একদিন বদলে যাবে- এই আশা নিয়ে বাঁচছেন চরবাসীরা। রায়পুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ইমরান খান বলেন, আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চেষ্টা করছি, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক করে দেওয়ার। তবে জমির সংকট বড় চ্যালেঞ্জ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত