এক সময় হবিগঞ্জের মাধবপুরে স্থানীয় কারিগরদের তৈরি পানি বিশুদ্ধিকরণ ফিল্টার সারা দেশে নাম ডাক ও ব্যাপক চাহিদা থাকলেও কালের পরিক্রমায় নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে জৌলুস হারিয়ে ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে। মাধবপুর থেকে ট্রাকভর্তি ফিল্টারের চালান পাঠানো হতো দেশের বিভিন্ন স্থানে। বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা অগ্রিম চাহিদা জানিয়ে নির্ধারিত সময়ে নিজেরা এসে মাল ডেলিভারি নিতেন।
জনসাধারণের মাঝে মাধবপুরের ফিল্টারের চাহিদাও ছিল ব্যাপক। ফিল্টারের জন্য দেশব্যাপী মাধবপুর একটি বিখ্যাত নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আশি এবং নব্বইয়ের দশকে স্থানীয় কারিগররা রাতদিন কাজ করে নিজস্ব প্রযুক্তিতে সিমেন্ট বালি আর মোজাইকের মিশ্রণ দিয়ে ৩/৪ স্থর বিশিষ্ট ফিল্টার বানাতে গিয়ে দম ফেলার ফুসরত পেতেন না।
সময়ের পরিবর্তনে নিত্য নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কঠিন প্রতিযোগীতার বাজারে টিকতে না পেরে অধিকাংশ কারিগর পেশা পরিবর্তন করেছেন। কেউ কেউ এখনও পৈত্রিক পেশাকে ভালোবেসে কষ্টে টিকে আছেন ফিল্টার তৈরির কাজে। বর্তমানে শুধু সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জায়গায় এবং ফরিদপুর জেলায় মাধবপুরের ফিল্টারের চাহিদা রয়েছে। ফিল্টার তৈরির কারিগর মাধবপুর কাছাড়িপাড়ার বাবুল মালাকারের স্ত্রী জানান, কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় এবং বাজারে মনোলোভা ডিজাইনের নিত্যনতুন দেশি বিদেশি মডেলের ফিল্টার সহজলভ্য হওয়ায় মানুষ এখন আর সিমেন্ট বালি ও মোজাইকের তৈরি ফিল্টার কিনতে আগ্রহ দেখায় না।
পূর্ব মাধবপুর ১নং ওয়ার্ডের খলিল ফিল্টার কারখানার মালিক খলিল মিয়া জানান, ফিল্টার তৈরির মূল কাঁচামাল চুনাপাথর, কুচিপাথর, সিমেন্ট, বালি, মোজাইক, সকেট ও ট্যাপের দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে যায়। বাজারে আকৃতি ভেদে একটি ফিল্টারের দাম ৭০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত রয়েছে। একই আকৃতির প্লাস্টিকের ফিল্টার কমবেশি ৩০০ থেকে ৭০০ টাকায় পাওয়া যায়। এ কারণে মাধবপুরের ঐতিহ্যবাহী ফিল্টার বাজার হারাচ্ছে। বাজারে প্রচলিত প্লাস্টিকের ফিল্টারের পানি অল্প সময় পরেই গরম হতে শুরু করে কিন্তু তাদের তৈরি ফিল্টারে পানি প্রাকৃতিকভাবে দীর্ঘসময় ঠান্ডা থাকে বলেও জানান তিনি।
তার মতে, চাহিদা কমে যাওয়ার পরেও দেশের নির্দিষ্ট কিছু এলাকাতে এখনও আমাদের তৈরি ফিল্টারের কিছু চাহিদা থাকায় আমরা লাভ কম জেনেও ব্যবসায়িক সম্পর্কের খাতিরে এবং পৈত্রিক পেশার প্রতি মমত্ববোধ থেকে কিছু কিছু ফিল্টার তৈরি করে সরবরাহ করি। তবে এখন ফিল্টার তৈরি আমাদের মূল পেশা নয়, কেন না শুধু ফিল্টার তৈরির আয় দিয়ে স্ত্রী সন্তান নিয়ে এই দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে কোনোভাবেই টিকে থাকা সম্ভব নয়।
কাচারিপাড়া ফিল্টার কারখানার মালিক লিটন বিশ্বাস জানান, বর্তমানে মাধবপুর পৌরসভার কাছারি এলাকায় ১৭টির মতো ফিল্টার কারখানায় ২০০ শ্রমিক ফিল্টার উৎপাদনের কাজ করছে। কারখানা ভেদে ২০০ থেকে ৩০০টি পর্যন্ত ফিল্টার প্রতিমাসে তৈরি করা হয়। কিন্তু উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে তেমন লাভ না থাকায় ফিল্টার কারিগরেরা পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে বলেও জানান তিনি। লিটন বিশ্বাস ও খলিল মিয়ার মতো আরও কয়েকজন কারিগরের সঙ্গে কথা বলে একইরকম চিত্র পাওয়া গেছে। তারা মাধবপুরের ঐতিহ্যবাহী ফিল্টার কারখানাগুলো টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে প্রণোদনা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।