বাংলাদেশের রেল ইতিহাসের প্রথম স্টেশন কুষ্টিয়ার জগতির ঐতিহ্যবাহী রেল স্টেশনটি এখন অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। প্রতিদিন স্টেশনটির বুক চিরে দ্রুতগতিতে ট্র্র্রেন ছুটে যায় ঠিকই, তবে এই স্টেশনে নেই কোনো ট্রেনের গন্তব্য। রেল কর্তৃপক্ষের কাছে গুরুত্ব না পেয়ে স্টেশনটি ইতিহাস হয়ে কোনমতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ রেল হেরিটেজ হওয়া সত্ত্বেও এখন স্টেশনটি পরিত্যক্ত হয়ে রয়েছে। রেলওয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক বাংলাদেশের প্রথম রেল স্টেশন কুষ্টিয়ার জগতি রেল স্টেশনের অবস্থা জরাজীর্ণ ও খুবই নাজুক। দ্বিতলা স্টেশনের ভবনটির ছাদসহ আশপাশের দেয়ালে জন্মেছে আগাছা। ভবনে ধরেছে ফাটল। একসময় বাস্প চালিত ইঞ্জিনে পানি ব্যবহারের জন্য বিশাল আকৃতির পানির ট্যাংকটিতে জন্মেছে বটগাছ। বর্তমানে স্টেশনটিতে নেই কোনো নিরাপত্তা কর্মী। উন্মুক্ত স্টেশনটির পুরো এলাকা পরিণত হয়েছে চারণভূমিতে। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর কলকাতার রানাঘাট থেকে জগতি পর্যন্ত ৫৩.১১ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ চালু হয়। ফলে এই রেলপথটি চালু হওয়ার পর রেলওয়ের যাত্রা শুরু হয়। পরে ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি আভ্যন্তরীণ নদীবন্দর গোয়ালন্দ পর্যন্ত ৭৫ কিলোমিটার রেলপথ সম্প্রসারণ করা হয়। এক সময়ে যাত্রীদের কোলাহলে মুখরিত থাকতো এই স্টেশনটি। কর্তৃপক্ষের অবজ্ঞা ও চরম উদাসিনতায় রেলওয়ে বিভাগ ঐতিহ্য হারাচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এ বিষয়ে একের পর এক রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিলেও কোনো কাজ হয়নি। গতকাল শুক্রবার সকালে সরেজমিনে জগতি স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, জগতি রেল স্টেশন যেন এক ভুতের বাড়ি। স্টেশন মাস্টার তো দূরের কথা সেখানে গার্ড কিংবা টিকিট কাউন্টারও নেই। নেই যাত্রীদের বসার কোনো স্থান। প্লাটফরমে জন্মেছে গাছ ও লতাপাতা। অফিস রুমে নেই কোনো জানালা, দরজা থাকলেও তালা দেয়া। রয়েছে ট্রেনের সিডিউল বোর্ড যা সর্বশেষ ২০০৯ সালের। দ্বিতল ভবনের অফিসের ছাদ থেকে কংক্রিটের সঙ্গে ভেঙে পড়ছে লোহাও। দেয়ালের চারিদিকে ধরেছে ফাটল। কক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে সূর্যের আলো। প্রথম তলায় সবই লুটপাটের মতো অবস্থা হলেও দ্বিতীয় তলার জানালা থেকে বের হওয়া বটগাছ ও আগাছাগুলো বলে দেয় এর অবহেলার চিত্র। একসময় বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের পানি নেয়ার জন্য জগতির যে দিঘি ও পানির ট্যাঙ্ক ব্যবহার করতো সেই দিঘি ও ট্যাংকগুলোর অবস্থা আরো নাজুক। বিশাল আকৃতির পানির ট্যাংকটি এখন বৃহৎ বটদানী। বট গাছের ডালাপালায় ভর্তি হয়ে শোভা দিচ্ছে। আর দিঘিসহ অন্যান্য স্থাপনার অবস্থাও করুন। বর্তমানে একটা বাতিও জ্বলে না দেশের প্রথম এই স্টেশনটিতে। স্টেশনটি চালু থাকলে দেশের অর্থনৈতিতে বড় অবদান রাখতো। স্থানীয় বাসিন্দা রোকনুজ্জামান বলেন, দেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন হলো এই জগতি স্টেশন। কিন্তু এই স্টেশনে এখন কোনো আন্তঃনগর ট্রেন থামে না। তাই এই স্টেশনে যেন এই রুটের সব আন্তঃনগর ট্রেন থামে তার ব্যবস্থা করার জোর দাবি জানাই। এই স্টেশনটিকে আধুনিকায়ন করে রেলওয়ের সব সুযোগ সুবিধা দেয়ার কথা বলেন জাহাঙ্গীর আলম নামে এক ব্যক্তি। জগতি স্টেশন একটি ঐতিহ্যবাহী স্টেশন। এর সম্মান রক্ষার্থে সরকারের উদ্যোগ নেয়া উচিত। শফিউর রহমান বলেন, এই স্টেশনটি ব্রিটিশ আমলের তৈরি। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের সাক্ষী। কিন্তু এখানে একটি মাত্র লোকাল ট্রেন ছাড়া কোনো ট্রেন থামে না। ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এই স্টেশন পুনরায় চালু ও আধুনিকায়ন করা উচিত। এর ফলে শহরের যানজট কমবে। এটিকে টার্মিনাল স্টেশন হিসেবে আধুনিকায়ন করলে শ্রমজীবী মানুষের জন্য উপকার হবে।
এখানে বিভিন্ন শিল্প কলকারাখানা রয়েছে। বিশেষ করে কৃষিপণ্যসহ চাল পরিবহণে বিশেষ সুবিধা হবে। সালেহা খাতুন নামে এক নারী বলেন, এক সময় এই স্টেশনটি ছিল জাঁকজমকপূর্ণ। কিন্তু এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে প্রায়। কোনো আন্তঃনগর ট্রেন এখানে থামে না। রেলওয়ে সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে আছে স্টেশনটি। আমরা পুনরায় এই স্টেশনটি চালুর দাবি জানাই। এর মধ্যে একাধিকবার আন্তঃনগর ট্রেন থামিয়ে বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন স্থানীয়রা। প্রতিবারই রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে তারা শান্ত হয়। তবে তাদের আশা পূরণ হয়নি। স্থানীয়দের দাবিগুলো হলো-জগতি রেল-ভবনের সংস্কার করতে হবে, জগতি রেলস্টেশনকে আধুনিকায়ন করতে হবে, টিকিট অনলাইনে কেনার ব্যবস্থা করতে হবে, জগতি রেল স্টেশনের প্রথম রেল ভবনকে প্রত্নতাত্ত্বিক মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং জগতি রেল স্টেশনের পুরোনো ভবনের ছবি অনলাইন টিকিটের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এ ব্যাপারে রেলওয়ের খুলনা বিভাগের গার্ড (গ্রেড-২) মাহবুবুল ইসলাম জানান, দেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন হলো জগতি। স্টেশনটি বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবগত করেছি। আশা করছি স্টেশনটির ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন কর্তৃপক্ষ। কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন মাস্টার ইতিয়ারা খাতুন জানান, কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশন এবং পোড়াদহ জংশন স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে জগতি স্টেশন। বর্তমানে ওই স্টেশনটির কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে এটি বাংলাদেশের প্রথম রেল স্টেশন হওয়ায় সেখানে ঐতিহাসিক স্টেশন হিসেবে গণ্য হয়। ব্রিটিশ সময়ে এলাকার অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় স্টেশনটি নির্মাণ করা হয়েছিল।