ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ঈশ্বরদীতে ফলন বিপর্যয়ে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে লিচু

ঈশ্বরদীতে ফলন বিপর্যয়ে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে লিচু

লিচুর রাজধানী বলে খ্যাত ঈশ্বরদীতে রসালো ও মিষ্ট বোম্বাই লিচুর ফলন বিপর্যয়ের কারণে এবারে চড়া দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে বোম্বাই লিচু। ফজর নামাজের পর হতে জয়নগরের শিমুলতলা, দাশুড়িয়া ও আওতাপাড়া হাটে বিক্রি শুরু হয়ে সকাল ১০টা পর্যন্ত চলে লিচু বেচা-কেনা। কিন্তু এবারে সকাল ৭টার আগেই লিচু কেনা-বেচা শেষ হয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য বছরে ছোট-বড় ২০-২৫ ট্রাক লিচু প্রতিদিন বেচা-কেনা হলেও এবারে ফলন বিপর্যয়ের কারণে ২ ট্রাকও লিচু হাটে উঠে না। তবে বিভিন্ন বাগান থেকেও ব্যাপারীরা আগেভাগে লিচু ভাঙতে শুরু করেছেন। ঈশ্বরদীর রসালো ও সুস্বাদু লিচুর দেড় জুড়ে যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। দেশের মধ্যে ঈশ্বরদীতে সবচেয়ে বেশি লিচু উৎপন্ন হয়। সে কারণে ঈশ্বরদীকে লিচুর রাজধানী বলা হয়। ঈশ্বরদীতে সুস্বাদু ও বিখ্যাত বোম্বাই লিচু বেশি উৎপাদন হয়। ঈশ্বরদীর উৎপাদিত লিচু দিয়ে দেশে মানুষের লিচুর চাহিদা মেটানো হয়। কিন্তু এবারে অধিকাংশ গাছে মুকুলের পরিবর্তে নতুন কচিপাতা বেশি আসায় ফলনে ধস নেমেছে। ঈশ্বরদীতে ৩,১০০ হেক্টর জমিতে লিচু বাগান রয়েছে ১২ হাজার ৩৬০টি। গাছ রয়েছে ২ লাখ ৫২ হাজার। মুকুল পরিপূর্ণ প্রতি গাছে ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার লিচু ধরে। উপজেলার ছলিমপুর, সাহাপুর, পাকশী, দাশুড়িয়া, মুলাডুলি ও লক্ষীকুন্ডা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকায় শত শত বাগান রয়েছে। সবচেয়ে বেশি লিচু বাগান রয়েছে ছলিমপুর ও সাহাপুর ইউনিয়নে। ঈশ্বরদীতে মোজাফফর (দেশী) ও বোম্বাই জাতের লিচুর আবাদ হয় বেশি।

কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ঈশ্বরদীতে গত বছর ৩০ হাজার মেট্রিক টন লিচুর ফলন হয়েছিল। বিক্রয় মূল্য ছিল ৩৩৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এরও আগের বছর লিচু উৎপাদন হয় ২৭ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন। বাজার মূল্য ছিল ৪১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এবারে তার ভিন্ন চিত্র। জলবায়ুর প্রভাবে পরাগায়ন না হওয়ায় গাছে মুকুল কম এসেছে। এবারে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৯ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন। গতবছরের চেয়ে ১০ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন কম।

এবারে লিচুর বাজার মূল্য ধরা হয়েছে ২২৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। জলবায়ুর প্রভাবে আবহাওয়ার তারতম্য হয়েছে। ফেব্রুয়ারির শেষে লিচুর মুকুল আসার প্রাক্কালে হঠাৎ অসময়ে বৃষ্টির কারণে গাছে মুকুল বের না হয়ে বেশিরভাগ গাছে এসেছে নতুন কচি পাতা। এ কারণে ঈশ্বরদীতে এবার লিচুর ফলন বিপর্যয় হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ ও লিচু চাষিদের সাথে কথা বলে এসব জানা গেছে।

ঈশ্বরদীতে বাণিজ্যিকভাবে লিচু চাষির সংখ্যা ২১ হাজার। এছাড়াও ছোট-বড় বাগান ও বাড়ির আঙিনায় লিচু গাছ রয়েছে। লিচুর পরিচর্যা, বিপণন ও বাণিজ্যিকীকরণসহ আরও প্রায় ১০ হাজার নারী-পুরুষ লিচু সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে জড়িত থাকতো। কোনো কাজ না থাকায় কিন্তু এবারে তারা হতাশ বলে কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিনে লিচু বিক্রির মোকাম ও বাগানে ঘুরে চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৫০ বছরের মধ্যে লিচুর এত ভয়াবহ ধস হয়নি। জয়নগরের শিমুলতলা মোকামের আড়তদার আলম হোসেন বলেন, কয়েক বছর আগে ফলন কম এবং খরায় লিচু ঝরে পড়েছিল। কিন্তু এবছরের মতো ফলন বিপর্যয় তা আগে কখনও হয়নি। এক সপ্তাহের মধ্যে যা লিচু আছে তা শেষ হয়ে যাবে। অন্যান্য বছরে ৪০০-৫০০ কোটি টাকার মতো লিচু কেনা-বেচা হলেও এবারে ধস নেমেছে।

ঈশ্বরদী বাজারে ভালোমানের প্রতি হাজার বোম্বাই লিচু ৪ থেকে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। খুচরা লিচু বিক্রেতা মিজানুর রহমান বলেন, গতবারের তুলনায় এবার লিচু কম হয়েছে। বেশির ভাগ বাগানে লিচু নেই। হাট ও বাগান থেকে ৪ হাজার টাকা হাজার লিচু কেনা হচ্ছে। গাড়ি ভাড়া, খাজনাসহ অন্যান্য খরচও রয়েছে। খুচরা একশ লিচু ৫০০ টাকায় বিক্রি করছি। ছোট আকারের লিচু ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে আঁটি লিচু (মোজাফফর জাত) ২,৫০০ থেকে ৩,০০০ টাকা হাজারে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা।

ছলিমপুর গ্রামের চাষি ও লিচু ব্যবসায়ী রহমত সরদার তিন শতাধিক লিচু গাছ নিয়ে সাতটি বাগান কিনেছিলেন। তিনি বলেন, ৩০-৩৫ শতাংশ গাছে মুকুল আসছে। বাকি গাছে মুকুলই আসেনি। এরপর খরায় কিছু ঝরে গেছে। প্রায় সাত লাখ টাকা লোকসানের আশঙ্কা করছেন তিনি। জয়নগর শিমুলতলা হাটে লিচু বিক্রি করতে আসা শামসুল আলম জানান, ৩০টি গাছের মধ্যে ৭টি গাছে কিছু বোম্বাই লিচু ধরেছে। এবছর লিচু কম আশায় গাছের যত্ন নেওয়া হয়নি। তাই লিচু ভালো হয়নি। কিছু লিচু বিক্রি করার জন্য এসেছি। লিচু কম হওয়ায় লিচুর দাম এবারে প্রায় দ্বিগুণ। গতবারে পাইকারিতে লিচু ২,০০০ থেকে ২,৫০০ হাজার দরে বিক্রি করেছি। এবারে ৩,৫০০ থেকে ৪,৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বরিশালের ব্যপারী রহমত তালুকদার বলেন, হাটে লিচু কম, মানও ভালো না, আবার দামও দ্বিগুণ। কিভাবে কি করব বুঝে উঠতে পারছি না।

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মিতা সরকার জানান, ঈশ্বরদীর লিচু বাগানের গাছে গতবারের তুলনায় এবার মুকুল কম এসেছে। লিচুর ফলন বিপর্যয় সম্পর্কে তিনি বলেন, মুকুল আসার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বৃষ্টি হয়। অসময়ে বৃষ্টিপাত হওয়ায় মুকুলের পরিবর্তে অধিকাংশ গাছে নতুন কচি পাতা এসেছে। এ কারণে কিছুটা ফলন বিপর্যয় হয়েছে। বিগত বছর হেক্টর প্রতি ৯ মেট্রিক টন লিচু হলেও এবারে ফলন হয়েছে ৬ টনের কম। ফলন কমে যাওয়ায় হাট-বাজারে লিচুর সরবরাহ কমেছে। লিচুর দাম অনেক বেশি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত