ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫, ৩০ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ব্যবসার গুরুত্ব ও আবশ্যিকতা

* ধন-সম্পদের মোহে পড়ে অর্থ উপার্জনে ব্যস্ততার অজুহাতে ইবাদতের শৈথিল্য প্রদর্শন করা যাবে না। ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলো যথা- নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি যথানিয়মে আদায় করতে হবে
ব্যবসার গুরুত্ব ও আবশ্যিকতা

মানুষের যাপিত জীবনে অর্থকড়ির আবেদনকে যেমন অস্বীকার করা যায় না, তেমনি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বও অর্থকে উপেক্ষা করে এক পা চলতে পারে না। সচল, সুস্থ, নিরাপদ ও উন্নত রাষ্ট্রের মেরুদণ্ডই হচ্ছে সুষম অর্থব্যবস্থা। তাই ব্যক্তি জীবন থেকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত সব অঙ্গনে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে হলে ভাবতে হয় অর্থনৈতিক উন্নতির কথা। জীবনে শান্তি, স্বস্তি, সম্মান ও নিরাপত্তায় বাঁচতে হলেও চাই পরিমিত সম্পদ। আর অর্থোপার্জনের স্বাধীন ও সরল উপায় হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। জীবিকা লাভের সম্মানজনক এ পন্থা প্রসঙ্গে বিশ্বশান্তির অগ্রদূত প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, ‘রিজিকের দশ ভাগের নয় ভাগই রয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে।’ (কানযুল উম্মাল : ৯৩৪২)। তাই হালাল পন্থায় জীবিকা উপার্জনের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সেই সঙ্গে সাধ্যানুযায়ী পরিশ্রমও করতে হবে। পুরোনো দিনের একটি চমৎকার প্রবাদ আছে, ‘পরিশ্রম ধন আনে, পুণ্য আনে সুখ; আলস্য দারিদ্র আনে, পাপ আনে দুঃখ।’

ব্যবসা উপার্জনের সম্মানজনক পন্থা : বুকের সিন্দুকে যাদের ঈমানের ধন আছে, তাদের জন্য ব্যবসা ইসলামের একটি ফজিলতপূর্ণ ইবাদত, সুন্নাহসম্মত আমল। তাই ব্যবসা করতে হবে ইবাদতের নিয়তে, হালাল উপার্জনের লক্ষ্যে; সততা, বিশ্বস্ততা এবং পরার্থপরায়ণতার সঙ্গে। তবেই ব্যবসায়ীর জীবন যেমন পার্থিব সফলতায় হবে সুপ্রতিষ্ঠিত, তেমনি রাষ্ট্রীয় অর্থব্যবস্থার মেরুদণ্ডও হবে সোজা, সমৃদ্ধ ও ন্যায়সম্মত। রাফি ইবনে খাদিজ (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, একবার রাসুল (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলো, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! কোন উপার্জন সবচেয়ে পবিত্র?’ তিনি বললেন, ‘ব্যক্তির নিজ হাতে উপার্জন এবং সব সততাপূর্ণ ব্যবসা।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৭২৬৫)। চেতনার বাতিঘর প্রিয় নবীজি (সা.) নিজেও এক সময় ব্যবসা করতেন। ব্যবসায় তার সততা, বিশ্বস্ততা ও আমানতদারিতার যেমন খ্যাতি ছিল, তেমনি খ্যাতি ছিল অভাবনীয় সফলতারও। তার অবাক করা বিশ্বস্ততাপূর্ণ আদর্শ ব্যবসায়ী পরিচয়ই গোটা আরব জাতিকে মুগ্ধ করেছিল এবং খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কের সেতু রচনা করেছিল। ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-ও ছিলেন একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী। আর ওসমান (রা.) তো অঢেল বিত্ত-বৈভব ও সফল ব্যবসায় ছিলেন প্রবাদপুরুষ। মক্কাবাসীর এ ব্যবসায়িক চরিত্রের কথা পবিত্র কোরআনেও বিবৃত হয়েছে।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কোরাইশদের যেহেতু আসক্তি আছে; আসক্তি আছে তাদের শীত ও গ্রীষ্মের সফরের। অতএব, তারা ইবাদত করুক এই ঘরের মালিকের, যিনি তাদের খোদায়ি আহার দিয়েছেন এবং ভীত থেকে নিরাপদ করেছেন।’ (সুরা কোরাইশ : ১-৪)। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘মক্কাবাসী খুব দারিদ্র্য ও কষ্টে দিনাতিপাত করত। অবশেষে রাসুল (সা.)-এর প্রপিতামহ হাশেম সর্বপ্রথম তাদের ভিন দেশে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি আগ্রহী করে তোলেন। কোরাইশরা তখন ব্যবসার প্রতি মনোযোগী হন। সিরিয়া ছিল শীতপ্রধান অঞ্চল। গরমের সময় সেখানে চলে যেতেন। আর ইয়ামেন ছিল গরমপ্রধান অঞ্চল। তাই শীতকালীন সফরের জন্য তারা ইয়েমেনকে নির্বাচন করেন। এভাবে শীত-গ্রীষ্মে বাণিজ্য করে সম্পদশালী হয়ে ওঠেন।’ (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন : ৮/৮২৩)।

উন্নতি ও দারিদ্র্য বিমোচনের আমল : ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘এ কারণেই যে ব্যক্তি এ আয়াতের নির্দেশ অনুযায়ী আল্লাহতায়ালার ইবাদত করে, আল্লাহতায়ালা তার জন্য উভয় জাহানে নিরাপদ ও শংকামুক্ত থাকার ব্যবস্থা করে দেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইবাদতের প্রতি বিমুখ হয়, তার কাছ থেকে উভয় প্রকার শান্তি ও নিরাপত্তা ছিনিয়ে নেওয়া হয়।’ অন্য এক আয়াতে আছে, ‘আল্লাহতায়ালা একটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। এক জনপদের অধিবাসীরা সর্বপ্রকার বিপদাশঙ্কা থেকে মুক্ত হয়ে জীবনযাপন করত। তাদের কাছে সব জায়গা থেকে প্রচুর পরিমাণে জীবনোপকরণ আসত। অতঃপর তারা আল্লাহর নেয়ামতসমূহের না-শোকরি করল এবং আল্লাহতায়ালা তাদের কৃতকর্মের কারণে তাদের ক্ষুধা ও ভয়ের স্বাদ আস্বাদন করালেন।’ (সুরা নাহল : ১১২)।

আবুল হাসান কাজবিনি (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি শত্রু বা বিপদের আশঙ্কা করে, তার জন্য সুরা কোরাইশের তেলাওয়াত নিরাপত্তার রক্ষাকবচ।’ এ কথা উদ্বৃত করে ইমাম জাযারি (রহ.) বলেন, ‘এটা পরীক্ষিত আমল।’ কাজী সানাউল্লাহ পানিপথি (রহ.) তাফসিরে মাজহারিতে বলেন, ‘আমাকে আমার মুর্শিদ মির্জা মাজহার জানজানা (রহ.) বিপদাপদের সময় এ সুরা তেলাওয়াত করার আদেশ দিয়েছেন। বলেছেন, প্রত্যেক বালা-মসিবত দূর করার জন্য এটা পরীক্ষিত এবং অব্যর্থ।’ কাজী সানাউল্লাহ (রহ.) আরও বলেন, ‘আমি বারবার এটা পরীক্ষা করেছি।’ (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন : ৮/৮২৪)।

ব্যবসার আদর্শ সময় : প্রত্যেক কাজের একটি আদর্শ সময় থাকে। সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করা হলে যেমনিভাবে সবকিছুতে বরকত ও কল্যাণ পাওয়া যায়, তেমনি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য ও সফলতা অর্জিত হয়। ব্যবসায় বরকত ও প্রাচুর্য লাভের আদর্শ সময় হচ্ছে ভোরবেলা। সাত সকালে কর্মব্যস্ততা, ব্যবসা এবং জীবিকা নির্বাহের মাধ্যমে অহরহ কল্যাণ আসে। কেননা, সকালের স্নিগ্ধ সময়টি অত্যন্ত বরকতপূর্ণ। তাছাড়া প্রিয়নবী (সা.) এ সময়ের বরকত ও কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে দোয়া করেছেন। সাখার আলগামেদি (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল বলেন, ‘হে আল্লাহ! আমার উম্মতের (কাজকর্মে) ভোরবেলায় বরকত দান করুন।’ রাসুল (সা.) বড় বাহিনী কিংবা ক্ষুদ্র কোনো যোদ্ধাদল কোথাও পাঠালে ভোরবেলায় পাঠাতেন। (এ হাদিসের বর্ণনাকারী) সাখার (রা.) ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনি তার ব্যবসায়ী কাফেলাকেও কোথাও পাঠালে ভোরে পাঠাতেন। ফলে তিনি ধনী ও প্রভূত সম্পদের অধিকারী হয়ে ওঠেন। (তিরমিজি : ১২১২)। বেদনার কথা হলো, অধিকাংশ মানুষ এ কল্যাণকর সময়ে ঘুমের ঘোরে বিভোর থাকে। শয়তানের কাছে পরাজয় লাভ করেই দিনের সূচনা করে। কাকডাকা ভোরে কিচিরমিচির আওয়াজে মেতে ওঠে নানা প্রজাতির পাখি। অথচ সৃষ্টির সেরা জীব মানবজাতির ঘুম ভাঙে রাঙা সূর্যের প্রখর আলোয়। সকালের সুনসান নীরবতায় অপার্থিব ভালোলাগা কাজ করে। সেই সোনালি সময়ে যে কোনো কাজ করা যায় পরম স্বস্তি ও মুগ্ধতায়। যারা এ সুবর্ণ সুযোগকে লুফে নেয়, তাদের রিজিকে বরকত আসে অকল্পনীয়ভাবে।

ব্যবসায় সততা অপরিহার্য : ইসলাম উপার্জনের পেশা হিসেবে হালাল পথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে যেমন উৎসাহিত করে, তেমনি অবৈধ পন্থায় অর্থোপার্জনকে চরম ঘৃণার চোখে দেখে। মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অবৈধ উপায়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার ঘৃণ্য মানসিকতা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে। দৃষ্টি ভ্রমের কারণে সাময়িক লাভ পরিলক্ষিত হলেও এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। কাজেই অন্যায়, জুলুম, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, সুদ, ঘুষ, কালোবাজারি ইত্যাদি খুবই জঘন্য কাজ। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক চাকাও স্থবির হয়ে পড়ে। তাছাড়া এর ফলে আল্লাহর ভয়ানক আজাবও ধেয়ে আসতে পারে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন ব্যবসায়ীদের ফাসেক বা গোনাহগাররূপে তোলা হবে; কিন্তু যেসব ব্যবসায়ী আল্লাহতায়ালাকে ভয় করে নির্ভুলভাবে কাজ করে এবং সততা ধারণ করে, তারা এর ব্যতিক্রম।’ (তিরমিজি : ১২১০)।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর সততা : ইমাম আবু হানিফা (রহ.) জ্ঞানের আকাশে যেমন উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন, তেমনি ছিলেন তাকওয়া-পরহেজগারিতা ও সততায় প্রবাদ পুরুষ। বর্ণিত আছে, মদিনা শরিফের এক ক্রেতা এসেছেন ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ব্যবসাকেন্দ্রে। তিনি ছিলেন না। তার এক কর্মচারী চারশ’ দিরহাম মূল্যের একটি গরম কাপড় এক হাজার দিরহামে গছিয়ে দেয়। বিষয়টি যখন ইমাম আবু হানিফা (রহ.) জানতে পারেন, তখন লোকটির পোশাক ও দেহের গঠন-আকৃতি জেনে বেরিয়ে পড়েন তার সন্ধানে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে মদিনা শরিফ গিয়ে পান। তারপর অনেক পীড়াপীড়ি করে ছয়শ’ দিরহাম ফেরৎ দেন। (মাকামে আবি হানিফা : ৮৯)। চিন্তার বিষয় হলো, এক বিন্দু সততার খাতিরে যুগের শ্রেষ্ঠ ইমাম পাহাড়, জঙ্গল, মরুভূমির পথ মাড়িয়ে অতিরিক্ত এবং স্বেচ্ছায় পরিশোধিত অর্থ ফিরিয়ে দিতে ছুটে চলেছেন অচেনা ক্রেতার সন্ধানে। সততার এমন দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল।

মজুদদারি ঘৃণ্য কাজ : কিছু অসাধু ব্যবসার মজ্জাগত অভ্যাস হচ্ছে, মজুদদারির আশ্রয় নিয়ে সুযোগ বুঝে কোপ মারা, অভাবের সময় কৃত্রিম সংকট তৈরি করা। এ যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা। এতে সাময়িক লাভবান হওয়া গেলেও পরিণতিতে নেমে আসে পরাক্রমশালী রবের ভয়াবহ আজাব। ধেয়ে আসে দারিদ্র, মহামারি এবং দুর্ভিক্ষ। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকে রেখে মজুদদারি করে (কৃত্রিম সংকট তৈরি করে), আল্লাহতায়ালা তাকে কুষ্ঠরোগ ও দারিদ্রতার কষাঘাতে শাস্তি দেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২১৫৫)।

ইবাদতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে : ধন-সম্পদের মোহে পড়ে অর্থ উপার্জনে ব্যস্ততার অজুহাতে ইবাদতের শৈথিল্য প্রদর্শন করা যাবে না। ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলো যথা- নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি যথানিয়মে আদায় করতে হবে।

নামাজের সময় ব্যবসা বন্ধ রেখে মসজিদমুখী হতে হবে। তবেই ব্যবসায় নেমে আসবে আসমানি বরকত ও অবারিত কল্যাণ। এমন নেককার ব্যবসায়ীদের প্রশংসায় পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সেসব লোক, যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে এবং নামাজ কায়েম ও জাকাত প্রদান থেকে বিরত রাখে না, তারা ভয় করে সেদিনকে, যেদিন বহু অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।’ (সুরা নুর : ৩৭)।

ব্যবসার গুরুত্ব,রাষ্ট্রীয় জীবন,সম্মানজনক পন্থা,দারিদ্র্য বিমোচন,মজুদদারি,ইবাদতকে অগ্রাধিকার
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত