চতুর্থ দিন শেষে জমে উঠেছে গল টেস্টে ব্যাট বলের লড়াই। বাংলাদেশের লিড ২০০ ছুঁই ছুঁই। দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দুই ইনিংসেই রান করেছেন অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। ওপেনিং থেকে দারুন সাপোর্ট দিয়েছেন সাদমান ইসলাম। ফলে পঞ্চম ও শেষ দিনে ভালো কিছুর স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে যে জুটিতে নির্ভর করে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল সফরকারীরা, দ্বিতীয় ইনিংসেও সেই জুটিতে তাকিয়ে দল। মুশফিকুর রহিম ও নাজমুল হোসেন শান্ত দিন শেষে অপরাজিত আছেন। দুজনের ব্যাটে চড়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ৩ উইকেটে ১৭৭ রান বাংলাদেশের। ১০ রানের লিড থাকায় নাজমুল শান্তরা এগিয়ে আছে ১৮৭ রানে। শান্ত অপরাজিত আছেন ১১৩ বলে ৫৬ রানে। টেস্টে তার ষষ্ঠ হাফসেঞ্চুরির পথে এই ফরম্যাটে দুই হাজার রানের কোটাও পার করেছেন। মুশফিক অপরাজিত আছেন ৪৩ বলে ২২ রান করে।
বাংলাদেশের হয়ে নবম ব্যাটার হিসেবে টেস্টে দুই হাজারের কোটা ছুঁয়েছেন শান্ত। মুশফিকের সঙ্গে ৪৯ রানের জুটির আগে সাদমান ইসলামকে নিয়েও কার্যকর জুটি গড়েছেন শান্ত। ১২৬ বলে ৭৬ রান করা সাদমানের সঙ্গে শান্তর জুটি ছিল ৬৮ রানের। সাদমান পেয়েছেন তার সপ্তম টেস্ট ফিফটি।
এর আগে নাঈম হাসানের দুর্দান্ত স্পিনে ম্যাচে দারুণভাবে ফিরেছিল বাংলাদেশ। দেশের বাইরে এই প্রথম পাঁচ উইকেট নিলেন নাঈম। বলা যায় দেশের বাইরে টেস্টে তার এই ম্যাচ দিয়ে অভিষেকও। ২০১৮ সালে নাঈম হাসানের টেস্ট অভিষেক। ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সাদা পোশাকে পথচলা শুরু। সাত বছর পর নাঈমের দীর্ঘ এক অপেক্ষা ফুরাল। দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট ম্যাচে বোলিংয়ের সুযোগ পেলেন তিনি। সে হিসেবে এটাকে বলা যায় অ্যাওয়ে ‘অভিষেক’। যেখানে ৫ উইকেট নিয়ে নাঈম নিজেকে প্রমাণ করেছেন। ২০১৯ সালে ইডেনে নাঈমের খেলার সুযোগ হয়েছিল। একাদশে থেকে প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং করে ১৯ রান করেছিলেন। কিন্তু ২২ গজে হাত ঘোরানো হয়নি। ফিল্ডিংয়ে চোট পাওয়ায় নাঈম ছিটকে যান। ফলে তার অ্যাওয়ে ম্যাচে বোলিংয়ের অভিষেকের অপেক্ষা দীর্ঘ হয়। টেস্ট ক্যাপ পাওয়ার সাত বছর পর দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট খেলেই বাজিমাত করলেন। ক্যারিয়ারের চতুর্থ ফাইফারের স্বাদ পেলেন। ৪৩.২ ওভার হাত ঘুরিয়ে ১২১ রানে ৫ উইকেট নেন এই অফস্পিনার। এর আগে তিনবার ফাইফার পেয়েছেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রামে ৬ উইকেট পেয়েছিলেন যা তার ক্যারিয়ার সেরা। এছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আছে ৫ উইকেট পাওয়ার কীর্তি। সাত বছরের লম্বা ক্যারিয়ারে নাঈম ঘরের মাঠেও খুব বেশি ম্যাচ খেলেননি। এই ম্যাচের আগে তার টেস্টের সংখ্যা ছিল ১২টি। সব মিলিয়ে ১৩ টেস্টে তার উইকেট ৪৪টি।
এই ম্যাচেও তার খেলা হতো কিনা সেটাও বিরাট প্রশ্নের। দেশের মাটিতে বাংলাদেশ দুই ডান হাতি অফস্পিনার খেলানোর চিন্তা করতে পারে টিম ম্যানেজমেন্ট। মিরাজ ও নাঈম একই সঙ্গে খেলতে পারেন। দেশের বাইরে সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। ব্যাটিংয়ে এগিয়ে থাকায় মিরাজ হয়ে যান অটোমেটিক চয়েজ। ফলে নাঈমকে থাকতে হয় ডাগআউটে। থাকতে হয় সুযোগের অপেক্ষায়। এই টেস্টের আগে হঠাৎ মিরাজের জ্বর আসায় নাঈমের ভাগ্য খুলে যায়। অফস্পিনারের সুযোগ হয় হাত ঘুরানোর। সুযোগটি দারুণভাবে কাজে লাগিয়ে ফাইফারের স্বাদ পেয়ে গেলেন অ্যাওয়ে অভিষেকেই।
গতকাল শুক্রবার গল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে সিরিজের প্রথম টেস্টের চতুর্থ দিনের দ্বিতীয় সেশনে স্বাগতিকদের প্রথম ইনিংস থেমেছে ৪৮৫ রানে। টস জিতে আগে ব্যাট করা বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ৪৯৫ রান তোলায় ১০ রানের ছোট একটি লিড মিলেছে তাদের। অথচ এক পর্যায়ে লঙ্কানরাই লিড নেওয়ার জন্য শক্ত অবস্থানে ছিল। তবে লাঞ্চ বিরতির পর খেলা শুরু হলে মাত্র ২০ রানে তাদের শেষ ৪ উইকেট তুলে নেয় টাইগাররা। সেখানে মূল ভূমিকা রাখেন ২৫ বছর বয়সী নাঈম। ৪৩.২ ওভার বল করে ১২১ রান খরচায় ৫ উইকেট নেন তিনি। ১৩ টেস্টের ক্যারিয়ারে নাঈমের এটি চতুর্থ ৫ উইকেট। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এই স্বাদ তিনি পেলেন দ্বিতীয়বার। ২০২২ সালের মেতে চট্টগ্রামে দলটির বিপরীতে ১০৫ রান খরচায় ৬ উইকেট শিকার করেছিলেন, যা তার ক্যারিয়ার সেরা বোলিংয়ের নজির।
এদিন শ্রীলঙ্কা লাঞ্চে গিয়েছিল ৬ উইকেটে ৪৬৫ রান নিয়ে। অর্থাৎ বাংলাদেশের পুঁজি থেকে মাত্র ৩০ রান পিছিয়ে ছিল তারা। হাতে ছিল ৪ উইকেট। ক্রিজে থিতু হয়ে কামিন্দু মেন্ডিস পাচ্ছিলেন সেঞ্চুরির সুবাস। তাকে যোগ্য সঙ্গ দিচ্ছিলেন মিলন রত্নায়েকে। দুজনের অবিচ্ছিন্ন সপ্তম উইকেট জুটির রান তখন ছিল ৭৯। বিরতির পর নাঈমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দল হাজির হয় অন্যরূপে। অভাবনীয় কায়দায় তারা আদায় করে নেয় লিড। দ্বিতীয় সেশনের তৃতীয় ওভারে শ্রীলঙ্কার ইনিংসে আঘাত করেন পেসার হাসান মাহমুদ। পুল করতে গিয়ে তার বল স্টাম্পে টেনে বোল্ড হন মিলন (৮৩ বলে ৩৯ রান)।
৮৪ রানের জুটি ভাঙার পর নাঈম মেলে ধরেন নিজেকে। পরের ওভারেই জোড়া শিকার ধরেন তিনি। প্রথম বলে বিপজ্জনক কামিন্দুকে (১৪৮ বলে ৮৭ রান) বিদায় করেন। টার্ন ও বাউন্সে পরাস্ত হন এই সংস্করণে বাংলাদেশের বিপক্ষে পাঁচ ইনিংসের মধ্যে তৃতীয় সেঞ্চুরির পথে থাকা লঙ্কান ব্যাটার। উইকেটের পেছনে দারুণ ক্যাচ নেন লিটন দাস। শেষ বলে লাইন মিস করে স্টাম্প হারান অভিষিক্ত থারিন্দু রত্নায়েকে (৭ বলে শূন্য)। এরপর আসিতা ফার্নান্দোকে (৮ বলে ৪ রান) বোল্ড করে শ্রীলঙ্কাকে অলআউট করে দেন নাঈম। আগের দিন শুধু দিনেশ চান্দিমালের উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। এদিন কামিন্দু, থারিন্দু ও আসিতাকে সাজঘরে পাঠানোর আগে সকালে তিনি বিদায় করেন স্বাগতিক অধিনায়ক ধনঞ্জয়া ডি সিলভাকে।
নাঈমের দ্যুতিতেই ১২১ রানে শ্রীলঙ্কার শেষ ৬ উইকেট নিতে পেরেছে বাংলাদেশ। এছাড়া হাসান মাহমুদও তার তিন উইকেটের দুটি নিয়েছেন লঙ্কানদের লেজের ব্যাটারদের মধ্য থেকে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশকে লিড দেওয়ার চ্যালেঞ্জ জানাতে বসা স্বাগতিকদের আটকে দিয়ে উল্টো লিড নিতে পেরেছে বাংলাদেশ। বোলাররা তাদের কাজটা করে দিয়েছেন। প্রথম ইনিংসে ব্যাটাররাও নিজেদের কাজ সেরেছেন। এবার দ্বিতীয় ইনিংসের চ্যালেঞ্জ। বরাবরের মতো প্রথম ইনিংসে ভালো করে দ্বিতীয়টিতে লেজেগোবড়ে করার ব্যাপারটি ফিরে আসেনি। শান্তর নেতৃত্বে ব্যাটাররা দারুণ করছেন। তাই গলে ভালো কিছুর স্বপ্নও দেখছে বাংলাদেশ।