আবহমান কাল থেকে গ্রাম বাংলায় কৃষকরা খেতের ফসলকে পশু-পাখি, ইঁদুর ও মানুষের কুণ্ডনজরের হাত হতে রক্ষা করার কৌশল জন্য অদ্ভুত ও এক অভিনব পদ্ধতির আবিষ্কার করেন। আদিকাল হতে এ রকম এক প্রহরীকে ফসলের খেতে দেখতে পাওয়া যায়। যার নাম কাকতাড়ুয়াা। গ্রাম বাংলার এই গ্রামীণ জনপদে ফসলের খেতের অতি পরিচিত দৃশ্য হলো এই কাকতাড়ুয়াা। কালের প্রবাহে ফসল রক্ষার এই সনাতন পদ্ধতিটি গ্রাম বাংলার বিমূর্ত প্রতীক হয়ে উঠে আসে গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, সিনেমায়। এর পর কাকতাড়ুয়াা আধুনিক সভ্য সমাজে পৌঁছে যায় শিল্পীর চিত্রকর্মে বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদে প্রচ্ছদে। গ্রাম বাংলার গ্রামীণ জনপদে আজও একটি প্রবাদ আছে- যাবার পথে কালো বিড়াল অতিক্রম করলে যাত্রা অশুভ হবে। পরীক্ষার আগে ডিম খেলে ফলাফল খারাপ হবে। গ্রামাঞ্চলে এখনো মায়েরা ছোট্ট শিশুর কপালে কালো টিপ এঁকে দেন, যাতে কারো নজর না লাগে। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগেও এমন অদ্ভুত বিশ্বাসের লোকের অভাব নেই গ্রামীণ জনপদে! তেমনই এক আত্মবিশ্বাস নিয়ে কৃষকরা খেতের ফসল রক্ষার্থে কাকতাড়ুয়াা (মানুষের প্রতীক) ব্যবহার করছেন। কৃষকদের আত্মবিশ্বাস, কাকতাড়ুয়াা স্থাপন করলে খেতের ফসল দেখে কেউ ঈর্ষা করবে না বা ফসলে কারো নজর লাগবে না। পশু-পাখি বা ইঁদুর ফসল নষ্ট করতে পারবে না। খেতের ফসল ভালো হবে। লম্বা খাড়া দণ্ডায়মান একটি খুটি এবং দুই বা তিন ফুট উপরে আড়াআড়ি আরেকটি খুটি বেঁধে তাতে ছন বা খড় পেঁচিয়ে মোটাসোটা করা হয়। তার পর আড়াআড়ি বাঁধানো অংশের সামান্য উপরে ছন বা খড়কুটো দিয়ে ডিম্বাকৃতি বা মাথার মতো বস্ত বানানো হয়। এর পর বাড়ি থেকে ব্যবহৃত পরিত্যক্ত ছেঁড়া জামা বা পাঞ্জাবি পরিয়ে দেয়া হয় এটিকে। ডিম্বাকৃতির অংশটিকে ঢেকে দেয়া হয় মাটির হাড়ি দিয়ে। সেই হড়িতে চোখণ্ড নাক-মুখ এঁকে দেয়া হয় চুন বা চক দিয়ে। ফলে এক অদ্ভুত অভিনব সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়। যা দেখে ভয় পাওয়ার মতো একটা ব্যাপার ঘটে। এই কাকতাড়ুয়াাকে ফসলি জমির মাঝখানে দণ্ডায়মান পুতে রাখা হয়। অনেকের বিশ্বাস কাকতাড়ুয়াা বাড়ন্ত ফসলের দিকে পথচারির কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা করে।
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় চাষাবাদের ধরন বদলে গেলেও লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলায় বিভিন্ন এলাকায় খেতের ফসল রক্ষায় কৃষকরা সনাতন পদ্ধতির কাকতাড়ুয়ার ব্যবহার করছেন। এটি মূলত কাক কিংবা অন্যান্য পশু-পাখিকে ভয় দেখানোর জন্য জমিতে রক্ষিত মানুষের প্রতিকৃতি বিশেষ। এর মাধ্যমে পশু-পাখিকে খেতের ফসল কিংবা বীজের রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে নিরুৎসাহিত করা হয়। দেখা যায়, ফসলি জমিতে পশু-পাখি তাড়ানোর জন্য জমির মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। দূর থেকে দেখলে যেন মনে হয় মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এই কাকতাড়ুয়াা দেখে খেতে পশু-পাখির উপদ্রব ঘটে না। ফলে ফসলও নষ্ট হয় না। এ মৌসুমে জমিতে বেগুন, খিরা, মরিচ, আলু, পেঁয়াজ, শসা, টমেটো, ধান ও গম জাতীয় ফসল রোপণ করা হয় তখনই এটি ব্যবহার করা হয়।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের কোদালখাতা গ্রামের নুরজ্জামালসহ একাধিক কৃষকরা জানান, কাকতাড়ুয়াা পশু-পাখিকে ভয় দেখানোর জন্যে জমিতে রক্ষিত মানুষের প্রতিকৃতি বিশেষ। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম খন্দকার বলেন, ফসলের কোনো ক্ষতি হবে না এমন আত্মবিশ্বাস থেকেই প্রত্যন্ত এলাকার কৃষকরা খেতে কাকতাড়ুয়াা স্থাপন করে। চাষাবাদে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় কৃষক আগের মতো আর কাকতাড়ুয়াা ব্যবহার করছে না। দিন দিন প্রতিটি এলাকায় কৃষকের কাছে পার্চিং ও আলোকফাঁদ পদ্ধতির ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অন্যদিকে লালমনিরহাট জেলার কৃষিপ্রেমীরা মনে করেছেন গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য হিসেবে কাকতাড়ুয়াা হাজার বছর বেঁচে থাকুক তাদের ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে এমনটি প্রত্যাশা করছেন তারা।
