পিরোজপুরের কাউখালী আমরাজুরি ইউনিয়নের সোনাকুর ও কাউখালী সদর ইউনিয়ন পালবাড়ি মৃৎশিল্পের জন্য এক সময় অনেক পরিচিত ছিল। এখানে দূর-দূরান্ত থেকে এমনকি দেশ-বিদেশ থেকেও পাল বাড়ি পালদের নিজের হাতে তৈরি করা মৃৎশিল্পের মালামাল নিতে আসতো পাইকারি ব্যবসায়ীরা। এই জায়গায় উৎপাদিত মাটির বিভিন্ন মালামালের চাহিদা ছিল অনেক। দেশের বিভিন্ন জেলা ঝালকাঠি, বাগেরহাট, কুমিল্লা, খুলনা, পটুয়াখালী, বরিশাল বরগুনাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসতো মাটির তৈরি হাড়ি, পাতিল, চাড়ি, শরা, টালি, পাটা, রসের হাড়ি, পানির কলস, দদির বাটি, মাটির কাপসহ বিভিন্ন প্রকার মালামাল নেয়ার জন্য। হাতের তৈরি করা মৃৎশিল্পের কারিগরদের ছিল অনেক জনপ্রিয়তা। এই সমস্ত বিষয় আজ যেন পুরনো ইতিহাস মাত্র। কারণ নদী ভায়নে পাল সম্প্রদায়কে নিঃস্ব করে দিয়েছে। মালামালের মূল্যবৃদ্ধি শ্রমিকের সংকটসহ নানান দৈন্যতায় দিশেহারা এই সম্প্রদায়। উপজেলার সোনসকুর গ্রামেই প্রায় দের শতাধিক পরিবার মাটি দিয়ে বিভিন্ন প্রকার হাড়ি পাতিল তৈরি করত। সন্ধ্যা নদীর ভাঙ্গনের মুখে সোনাকুর পাল বাড়ির প্রায় শতাধিক বসতবাড়ি ঘর নদী গ্রাস করে নিয়েছে। যে কারণে অনেকে ভূমিহীন হয়ে অন্য কোনো কাজ না জানায় পারি জমিয়েছে অন্যত্র। যারা দূরে যেতে পারেনি তারা বিভিন্ন আশ্রয়নে সরকারি ঘরে মাথা গোজার ঠাঁই করে নিয়েছে। যেখানে তাদের মৃৎশিল্পের কাজ করার পরিবেশ তৈরি করতে না পারায় অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। যার ফলে সংকুচিত হয়ে পড়েছে পালবাড়ির মাটির তৈরি মালামাল উৎপাদন। সরজমিনে উপস্থিত হয়ে অনেকের সাথে কথা হয়। এ সময় তারা তাদের মানবিক জীবন যাপনের বিষয় জানান। সনজিৎ পাল জানান এখানে বর্তমানে ২০ থেকে ২৫টি পরিবার এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত আছে। আগে মাটির তৈরি মালামালের একটি পুইন পুড়তে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ করে ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা বিক্রি করা যেত। আজ সেই একই মালামাল উৎপাদন করতে আগের চেয়ে দ্বিগুণ খরচ হয়।
একটি বড় পুইন পুড়তে প্রায় ৮০/৯০ হাজার টাকা খরচ করে বিক্রি করলে ৯০ থেকে ১ লাখ টাকার বেশি বিক্রি করা যায় না। এই ১০ হাজার টাকা লাভ করতে যে সময় এবং শ্রম ব্যয় করতে হয় তা থেকে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়াসহ ডালভাত খেতেও কষ্ট হয় পাল সম্প্রদায়ের। যে কারণে অনেকেই পেশা বদল করে অন্য কাজের দিক ঝুকছে। অর্থ সংকটের কারণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারছেন না। বাপ দাদা আমলের হাতে ঘুরানো চাকা দিয়েই তৈরি করতে হয় মাটির তৈরি হাড়ি পাতিল সহ অন্যান্য মালামাল। এতে একদিকে সময় ব্যয় হয় অন্যদিকে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়। যার ফলে অতিরিক্ত খরচ এবং উৎপাদন কম হওয়ায় পিছিয়ে পড়ছেন পাল সম্প্রদায়টি। এদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, নদীভাঙন কবলিত এলাকায় মৃৎশিল্প কারিগরদের পুনর্বাসনের জন্য আধুনিক মেশিন প্রদান করে তাদেরকে পূর্নবাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করার। এ ব্যাপারে রুহিদাস পাল বলেন তাদের দাবির ফলে কয়েক বছর আগে মৃৎশিল্প কারিগর রমেন পাল ও শংকর পালসহ ৫ জনকে পরীক্ষামূলক ভাবে আধুনিক পটাই মেশিন স্থাপনের জন্য প্রত্যেককে নগদ ৫ হাজার টাকা জেলা প্রশাসন প্রদান করেছিল এবং জানিয়েছিলেন পর্যায়ক্রমে সবাইকে আধুনিক মেশিন ও পূর্নবাসনের ব্যবস্থা করা হবে। অথচ আজ পর্যন্ত আমাদের আর কেউ খোঁজ রাখে না।
সুবিধাভোগী রমেন পাল বলেন- অনেক সময় শারীরিক অসুস্থতার কারণে চাকা ঘুরনো পদ্ধতিতে কাজ করতে পারতেন না, যে কারণে তাদের সংসারের নানা সংকট দেখা দিত। ফলে অর্ধাহারে অনাহারে দিন যাপন করতে হতো। সরকারিভাবে আধুনিক পটাই মেশিন পেয়ে কয়েক গুণ বেশি মাল তৈরি করতে পারেন। শংকর পাল বলেন আধুনিক পদ্ধতিতে পটাই মেশিন দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের মাল তৈরি করতে এখন আর কোনো সমস্যা হয় না। মাটির তৈরি ভালো ডিজাইনের প্লেট, গ্লাস, হারি, পাতিলের প্রচুর চাহিদা আছে। কাউখালির তৈরি মাটির গ্লাস বাটি দই এর কাপ, জালের পাটা এবং গাছের টপ টালির প্রচুর চাহিদা রয়েছে। পাড়েরহাট, স্বরূপকাঠি, রায়েন্দ, মঠবাড়িয়া, চরদোয়ানি এই সমস্ত এলাকায় মাছ ধরার জন্য কাউখালীর পাটার অনেক চাহিদা রয়েছে।
আধুনিক মেশিন না থাকার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এ সমস্ত মালামাল তৈরি করে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। সবাই যদি এই পটাই মেশিন পায় তাহলে আবার আগের মতই মৃৎশিল্পের প্রসার ঘটবে বলে দাবি করেন পাল সম্প্রদায়। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্বজল মোল্লা বলেন বিষয়টি তিনি অবগত আছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিজ্ঞ কয়েকজনকে আধুনিক মেশিন দেয়া হয়েছে, অভিজ্ঞদের পর্যায়ক্রমে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।