লোকসানের অযুহাতে দীর্ঘ ২৮ বছর আগে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ফেনী-বিলোনিয়া চলাচলকারী ট্রেন। বর্তমানে বেদখল ও লুট হয়ে গেছে পরিত্যক্ত রেলপথের ৮টি স্টেশনঘর ও সম্পদ। অযত্ন-অবহেলায় আগাছা জন্মে ভুতুড়ে অবস্থা ভবনগুলোর। দরজা-জানালা খুলে নিয়ে গেছে স্থানীয় বখাটে ও মাদকসেবীরা। চুরি হয়ে গেছে বহু স্লিপার ও সরঞ্জাম।
সরেজমিন দেখা যায়, ফেনী বিলোনিয়া রেলপথের মুন্সীরহাট, মোহাম্মদপুর, গাইনবাড়ি, বন্দুয়াসহ বহু জায়গায় রেললাইনের চিহ্নও নেই। রেললাইন এখন পরিণত হয়েছে সড়কপথে।
এছাড়া রেলের জায়গায় গড়ে উঠেছে অবৈধ দোকানপাট, ঘরবাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনা। এসব ঘটনায় লাকসাম জিআরপি থানায় ২৫-৩০টি মামলা হয়েছে।
২০১৯ সালে পুনরায় এ রেলপথটি চালুর জন্য নতুন সমীক্ষা হলেও তারপর থেকে এই উদ্যোগ নিয়ে আর কোনো কথা হয়নি। প্রচীন এই রেলপথটি পুনঃ চালুর দাবি স্থানীয়দের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ফেনীর পরশুরাম উপজেলার বিলোনিয়া সীমান্ত স্থলবন্দরের পাশে অবস্থিত বিলোনিয়া রেল স্টেশন। ১৯২৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর ফেনী থেকে বিলোনিয়া পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেলপথ স্থাপনের জন্য ২৫টি গ্রামের ২৭৭ একর জমি অধিগ্রহণ ও ১৯২৯ সালে ফেনীর সঙ্গে আসামের যোগাযোগ স্থাপনের জন্য আসাম বেঙ্গল রেল কোম্পানি ফেনী-বিলোনিয়া রেলপথটি নির্মাণ করে। এর মধ্যে ফেনী রেলস্টেশন থেকে পরশুরাম পর্যন্ত প্রায় ২৭ কিলোমিটার পথে তৈরি করে ৮টি স্টেশন। পরবর্তীতে এই পথ দিয়ে দুই দেশের যাত্রীরা আসা-যাওয়া ও ব্যবসায়ীরা পণ্যসামগ্রী আনা-নেওয়া করতেন।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর দুই দেশের মধ্যে যাত্রী চলাচল ও পণ্যসামগ্রী আনা-নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও ফেনী থেকে বিলোনিয়া সীমান্ত পর্যন্ত ছোট ছোট আটটি স্টেশন ছুঁয়ে রেলপথটি চালু ছিল। স্টেশনগুলো ছিল বন্দুয়া, দৌলতপুর, চিথলিয়া, পীরবক্স মুন্সীর হাট, নতুন মুন্সীর হাট, ফুলগাজী, পরশুরাম ও বিলোনিয়া সীমান্তে। কিন্তু ১৯৯৭ সালে তৎকালীন সরকার রেলপথটি লোকসানের অযুহাত দেখিয়ে বন্ধ করে দেয়। বিলোনিয়ার বাসিন্দা জাহিদ হোসেন বলেন, একসময় ফেনী বিলোনিয়া রেল লাইনটি আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু বর্তমানে বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীসহ মানুষের আসা যাওয়া এবং মালামাল আনা নেওয়ায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
ব্যবসায়ী রেজাউল গনি পলাশ বলেন, রেলপথটি চালু থাকলে ব্যবসায়ীদের পণ্য আনা-নেওয়ায় সুবিধা এবং সরকারের লাখ লাখ টাকা রাজস্ব আয় হতো। তাই এটি পুনরায় চালু করার দাবি জানান তিনি।
সিনিয়র সাংবাদিক আবু ইউসুফ মিন্টু বলেন, এই রেলপথটি আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ। কিন্তু বর্তমানে বন্ধ থাকায় ফেনী বিলোনিয়া রেল লাইনের স্লিপার চুরি, পরিত্যক্ত স্টেশনগুলো ভূতের বাড়িতে পরিণত হয়েছে। তাই রেলপথটি পুনরায় চালু হলে ফেনীর উত্তরাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ সুবিধা বাড়বে।
আমদানি-রপ্তানিকারক সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীরা জানান, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে স্থলবন্দরসংলগ্ন বিলোনিয়া রেলপথটি চালু হলে বাংলাদেশ থেকে অল্প খরচে ও স্বল্প সময়ে ইট, পাথর, সিমেন্ট, রড রপ্তানি সহজলভ্য হবে। ভারত থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানিও সহজ হবে।
ফেনী রেলস্টেশন সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে যাত্রীবাহী ট্রেনগুলো সরকারের সেবামূলক পরিবহন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যাত্রীদের কাছে টিকিট বিক্রি করে যে রাজস্ব পাওয়া যায়, তার কয়েক গুণ সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। কিন্তু মালবাহী ট্রেনের খরচ অত্যন্ত কম। এই ট্রেনে একজন সহকারী চালক ও একজন গার্ড দিয়ে মালামাল পরিবহন করে সরকারের লাখ লাখ টাকা রাজস্ব আয় করা সম্ভব। ফেনীর রেলস্টেশন মাস্টার হারুন জানান, এক সময় ফেনীতে রেল জংশন ছিল, বর্তমানে নেই। তবে ফেনী-বিলোনিয়া রেললাইন চালু হলে রেল জংশন সচল হবে এবং সরকারের রাজস্ব বাড়বে।