নওগাঁয় বাজারে উঠতে শুরু করেছে আম। বাজারে ক্ষিরসাপাত/হিমসাগর, নাক ফজলি, ল্যাংড়া/হাঁড়িভাঙ্গা ও আম্রপালি আম পাওয়া যাচ্ছে। তবে প্রশাসনের নিয়ম মানতে চান না ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের আগমন কম হওয়ায় ও সিন্ডিকেটের কারণে ন্যায্য দাম না পাওয়ায় হতাস আম চাষিরা।
এতে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে চাষিদের। প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানোর দাবি চাষিদের। জেলার সাপাহার উপজেলা সদরে বৃহৎ আমের বাজারে প্রায় ৩৫০টি আড়ত রয়েছে। এখন পর্যন্ত চালু হয়েছে ৮০-৯০টি। যেখানে প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হচ্ছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে এ বছর জেলায় আম বাগানের পরিমাণ ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর।
যা থেকে প্রায় ৪ লাখ টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা থেকে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার অধিক বাণিজ্যের আশা। বরেন্দ্র এলাকা হওয়ায় এ জেলার আম অত্যন্ত সুস্বাদু ও সুমিষ্ট। ফলে দেশজুড়ে আমের বেশ কদর রয়েছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হয়ে থাকে। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর বাজারে আসতে শুরু করেছে আম। সাপাহার উপজেলা সদরে জিরো পয়েন্টে আমের বৃহৎ বাজার।
আমের ভরা মৌসুমে জিরো পয়েন্ট থেকে গোডাউনপাড়া পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সড়কের এক পাশে বসে আমের বাজার। তবে মৌসুমের শুরুতে এক কিলোমিটারজুড়ে বাজার বসেছে। বাজারে ল্যাংড়া, খিরসা/হিমসাগর, নাক ফজলি, হাঁড়িভাঙ্গা, আম্রপালি ও ব্যানানা ম্যাংগো পাওয়া যাচ্ছে। চাষিরা বাগান থেকে আম পেড়ে সকাল থেকে ভ্যান, ভটভটিসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে এ বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে আসছে। তবে ব্যবসায়ীদের আনাগোনা কম থাকায় বেচাকেনা কম। বিক্রির জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে চাষিদের। আবারও দামও তুলনামূলক কম।
প্রতি মণ আম ল্যাংড়া ৮০০-১৫০০ টাকা, নাক ফজলি ও খিরসা/হিমসাগর ১২০০-১৬০০ টাকা, হাঁড়িভাঙ্গা ১৫০০-২৫০০ টাকা, আম্রপালি ২২০০-২৮০০ টাকা এবং ব্যানানা ম্যাংগো ২৫০০-২৮০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। এ বছর আম সংগ্রহের যে সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে তা কাজে আসছে না। প্রচণ্ড গরমে আম পেকে ঝরে পড়ছে। এ কারণে সব ধরনের আম প্রায় ১০ দিন আগেই বাজারে চলে আসছে। আম চাষিদের দীর্ঘদিনের দিনের দাবি ছিল কেজিদরে আম বেচাকেনা।
দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ জুন রাজশাহী বিভাগীয় পর্যায়ে কেজি দরে আম বেচাকেনা নিয়ে উপজেলা প্রশাসন, ব্যবসায়ী, আড়তদার ও আম চাষিদের নিয়ে আলোচনা হয়। কেজিদরে আম বেচাকেনার কথা থাকলেও বাস্তবে তার উল্টো চিত্র। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কাছে হার মানছে চাষিরা। তারা ক্যারেটসহ ৫০-৫২ কেজিতে মণ হিসাবে আম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। কেজিদরে আম বেচাকেনা করতে সাপাহার উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমের বাজারে সচেতনতামূলক মাইকিং করা হলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। প্রশাসনের দায়সারা ভাব মনে করছেন আম চাষিরা। আম চাষিরা বলছেন- মৌসুমের শুরু থেকে অনাবৃষ্টি ও প্রচণ্ড খরা বিরাজ করছিল। গাছে মুকুলের পরিমাণ বেশি দেখা দিলেও আম আসার পরিমাণ ছিল কম। ভালো দাম পাওয়ার কথা থাকলেও তার উল্টো চিত্র। আম চাষিদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কেজিদরে আম বেচাকনার সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন।
তবে কেজি দরে আম বেচাকেনা চালু হলে লাভবান হবেন চাষিরা। উপজেলার কোরালডাঙ্গা গ্রামের আম চাষি আব্দুল মতিন বলেন, তিন বিঘা জমিতে আম্রপালি জাতের আমবাগান রয়েছে। প্রচণ্ড গরমের কারণে গাছ থেকে আম ঝরে পড়ছে। বাধ্য হয়ে আম নামাতে হচ্ছে। কিন্তু বাজারে আমের দাম ভালো পাওয়া যাচ্ছে না। গত বছর মৌসুমের শুরুতে তিন হাজার টাকার ওপরে মণ বিক্রি হয়েছে। আর এ বছর দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা মণ। আবার ৫০-৫২ কেজিতে মণ হিসেবে বিক্রি করতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা কেজিদরে কিনতে চাচ্ছে না।
তাই বাধ্য হয়ে আগের নিয়মে দিতে হচ্ছে। সাপাহার গোডাউন পাড়ায় বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কের উদ্যোক্তা আম চাষি সোহেল রানা বলেন- কেজি দরে আম বেচাকেনা নিয়ে আম চাষিদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহী বিভাগীয় পর্যায়ে সবার সম্মতিক্রমে এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কেজিদরে আম বেচাকেনার কথা থাকলেও বাস্তবে তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। তারা কেজিদরে আম কিনতে চাচ্ছেন না। আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে আম বেচাকেনা বন্ধ করে দেয়। প্রশাসন শুধু মাইকিং করে দায় সারতে চাচ্ছেন। কেজিদরে আম বেচাকেনা বাস্তবায়ন করতে প্রশাসনের সহযোগিতা প্রয়োজন। এটা বাস্তবায়ন হলে আম চাষিরা লাভবান হবে। সাপাহার আড়তদার সমিতির সভাপতি শ্রী কার্তিক সাহা বলেন- প্রশাসনের নিয়ম মানতে চান না ব্যবসায়ীরা। কেজি দরে আম না কিনে ৫০-৫২ কেজিতে মণ হিসেবে কিনছেন তারা। ওজন বিভ্রান্ত হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী এখনও এ বাজারে আসছে না। এতে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে। আমের মণের ওজন নির্ধারণ করা না হলে ব্যবসায়ীরা আসতে চাচ্ছে না। অন্য জেলাগুলোতে আগের নিয়মে আম বেচাকেনা হচ্ছে। তিনি বলেন- কেজিদরে আম কেনা হলে বাছাই করে ভালোগুলো কেনা হচ্ছে। এতে করে আম চাষিরা চিল্লাপাল্লা করছে। তারাও এ ঝামেলা চান না বলেন গড়ে ৫০-৫২ কেজিতে মণ হিসাবে বিক্রি করছে।
নওগাঁ জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল আউয়াল বলেন- চলতি মাসের শুরুর দিকে রাজশাহী বিভাগীয় পর্যায়ে কেজিদরে আম বেচাকেনা নিয়ে উপজেলা প্রশাসন, ব্যবসায়ী, আড়ৎদার ও আম চাষীদের সাথে আলোচনা হয়। ইতোমধ্যে জেলায় আম বেচাকেনা শুরু হয়েছে। আম চাষিদের কাছ থেকে আড়তদাররা প্রতি কেজিতে দুই থেকে আড়াই টাকা হিসেবে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু কেজিদরে আম বেচাকেনার বিষয়টি কিছু জায়গায় মানা হচ্ছে না। যেখানে কেজি দরে আম বেচাকেনা করতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক মাইকিং করা হচ্ছে। কেজিদরে আম বেচাকেনা নিয়ে কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় বিষয়টি নিয়ে আবারও ব্যবসায়ী, আড়তদার ও আম চাষিদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। যদি এর ব্যত্যয় হয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।