বছরজুড়ে আশার আলো দেখিয়ে এবার মধুমাস জ্যৈষ্ঠ মাসে লিচু চাষিদের চোখে জল এনেছে ঈশ্বরদীর লিচু। হাটবাজারে উঠতে শুরু করেছে ঈশ্বরদীর সুমিষ্ট ও রসালো বোম্বাই লিচু। দাম মান ভেদে ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা শতকে বিক্রি হচ্ছে এই লিচু। লিচুর রাজধানীখ্যাত ঈশ্বরদীতে এবার ভয়াবহ ধস নেমেছে লিচুর ফলনে। অতীতে ব্যাপক উৎপাদন লক্ষ্য করা গেলেও এবার লিচুর স্বাভাবিক ফলনও হয়নি। লিচু চাষিরা বলছেন, এবার ২০ থেকে ৩০ ভাগ গাছে মুকুল বের হয়েছিল। বেশিরভাগ গাছেই মুকুলের সময়ে মুকুল না বের হয়ে কচি পাতা বের হয়।
গতকাল শনিবার সকাল থেকে সরেজমিন লিচুর মোকাম জয়নগরের শিমুলতলা, আওতাপাড়া, দাশুড়িয়া ট্রাফিক মোড়, পৌর শহরের রেলগেট, পোস্ট অফিস মোড়, স্টেশন রোডে গিয়ে দেখা যায়, জয়নগর শিমুলতলায় মৌসুমী ফল ব্যবসায়ীরা বোম্বাই লিচু বিক্রি করছেন। পাশাপাশি দেশি জাতের লিচুও বেচাকেনা করছেন। এখানে লিচু বিক্রির জন্য বেশ কয়েকটি আড়ত খোলা হয়েছে। রাজধানী ঢাকা, খুলনা, ঝিনাইদাহ, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লিচুর পাইকারি ক্রেতারা এইসব আড়ত, পাইকারি ব্যবসায়ী ও বাগান থেকে সরাসরি বোম্বাই লিচু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। জয়নগরে শিমুলতলায় লিচু বিক্রির আড়তদার চয়ন ইসলাম খান ও তৃপ্তি ফল ভাণ্ডারের আড়তদার মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বিটনসহ আড়তদারদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, তারা কমিশনের ভিত্তিতে লিচু বিক্রি করেন। লিচুর আড়তে কথা হয় সিলেট থেকে পাইকারি লিচু কিনতে আসা ফুল মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, এবার আজকেই প্রথম আমি এই মোকামে লিচু কিনতে এসেছি। চড়া দামে লিচু কিনে লাভ হবে কি না সেই শঙ্কায় আছি। এছাড়াও উপজেলার দাশুড়িয়া এবং পৌর শহরসহ বিভিন্ন হাটবাজারে পাইকারি ও খুচরা বোম্বাই লিচু বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। চাষি ও ব্যবসায়িকরা বলছেন, শুধু পাবনা জেলাতেই নয় দেশের অন্যতম বৃহত্তম লিচু উৎপাদনকারি অঞ্চল পাবনার ঈশ্বরদীতে ভালো নেই লিচু চাষিরা এবার । এমনিতেই এবার ফলন বিপর্যয় তার সঙ্গে যোগ হয়েছে গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা পড়েছে লিচুতে। বৃষ্টিতে লিচুর বোটায় পোকা লাগা শুরু হয়েছে। পোকা ফলের বোঁটার কাছে ছিদ্র করে ভিতরে ঢোকে এবং বীজকে আক্রমণ করে। পরে ছিদ্রের মুখে বাদামি রঙের এক প্রকার করাতের গুঁড়ার মতো মিহি গুঁড়া উৎপন্ন করে। এতে ফল নষ্ট হয় এবং বাজারমূল্য কমে যায় ।
উপজেলার আলহাজ বিসিআইসি সারের ডিলার ও কীটনাশক বিক্রেতা শামসুল আলমের মেসার্স এসবি ট্রেডার্সে কথা হয় কীটনাশক ছত্রকনাশক কিনতে আসা উপজেলার ছলিমপুর ইউনিয়নের চরমিরকামারী গ্রামের লিচু চাষি ইয়ারুল বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, তার ১৮টি গাছের মধ্যে মাত্র দুইটা গাছে হাফ আর একটা গাছে এক চতুর্থাংশ লিচু এসেছে। তাও যদি কয়েকদিনের বৃষ্টি হওয়াতে পোকায় খেয়ে নেয় সেই শঙ্কায় কীটনাশক কিনতে দোকানে এসেছেন। তিনি জানান, তার ১৮টি গাছের মধ্যে মাত্র দুইটা গাছে হাফ আর একটা গাছে এক চতুর্থাংশ লিচু এসেছে। চাষিরা পোকা দমনে লিচুর গাছে কীটনাশক, পচনের ছত্রাকনাশকসহ বিভিন্ন ঔষধ ব্যবহার করছেন। ওই দোকানদার শামসুল আলম জানান, তার ত্রিশটা লিচু গাছের মধ্যে মাত্র তিন-চারটা গাছে লিচু এসেছে। বৃষ্টি হওয়াতে লিচুর বোঁটায় পোকা হচ্ছে। পোকা দমনের জন্য কীটনাশক ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে। আবার কেউ কেউ পোকা লাগার শঙ্কায় আগেই বাগানের লিচু বেশি দাম পাওয়ার আশায় বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা অপরিপক্ব এসব লিচু বাজারে বিক্রি করছেন। অগ্রিম বাগান কেনা চাষিদের রীতিমতো মাথায় হাত। মকুল আসার আগেই যারা বেশি দামে বাগান কিনেছিলেন, তারা এখন লিচুর ভালো ফলন না পেয়ে লোকসান হওয়ার চিন্তায় হতাশ হয়েছেন। যেসব বোম্বাই লিচু বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর দামও চড়া। এসব লিচু সুস্বাদু বা রসালোও নয়, তাও নতুন ফলের স্বাদ নিতে অনেকেই কিনছেন।
উপজেলার জয়নগর কারিকরপাড়া এলাকার লিচু চাষি সামসুল আলম বলেন, তার প্রায় ১০০টি লিচু গাছ আছে। গত বছর নিজেদের খাওয়া ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য কয়েকটি গাছ রাখার পরেও ৭ লাখ টাকা বাগান বিক্রি করি। কিন্তু এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। কয়েকটি গাছে মাত্র লিচু এসেছে। তিনি বলেন, ৫০ বছরের লিচু চাষের ইতিহাসে এমন ফলন বিপর্যয় দেখিনি।
লিচুতে জাতীয় পদকপ্রাপ্ত চাষি আব্দুল জলিল কিতাব মণ্ডল ওরফে লিচু কিতাব বলেন, লিচু চাষে আমার ৪৫ বছরের ইতিহাসে এমন ফলন বিপর্যয় দেখিনি। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এবছর ঈশ্বরদীতে ৩ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। লিচুর জাতের মধ্যে রয়েছে মোজাফ্ফর (দেশি), বোম্বাই ও চায়না। তবে অন্যবারের তুলনায় এবার ফলন একেবারেই কম।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মিতা সরকার জানান, এ বছর ঈশ্বরদীতে ৩১০০ হেক্টরেরও বেশি জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। প্রথম দিকে আবহাওয়া প্রতিকূল হওয়ায় এবার অর্ধেকেরও বেশি গাছে মুকুল আসেনি। জলবায়ু পরিবর্তন, বৈরি আবহাওয়া ও পরাগায়নের জটিলতার কারণে এবার ঈশ্বরদীতে লিচুর ফলন অন্যবারের তুলনায় অনেক কম।
উল্লেখ্য, ঈশ্বরদীর লিচু তার স্বাদ, গন্ধ ও রসালো মিষ্টতার কারণে দেশজুড়ে সুপরিচিত। দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকাররা এরই মধ্যে ঈশ্বরদীর মোকামে আসতে শুরু করেছে।