কৃষক শংকর কুমার মৈত্র তার নিজ গ্রাম উপজেলার ভাটপাড়া মাঠে ১৫০ শতক জমিতে ব্রি ধান- ৯২ (জাত) চাষ করেছেন। এবার তিনি প্রথমবারের মতো আধুনিক পদ্ধতিতে যন্ত্রের মাধ্যমে ধান রোপণ করেছেন। চাষের ক্ষেত্রে তিনি লক্ষ্য করলেন, হাতে ধান রোপণের সময় প্রায় ৫০ দিন বয়সী চারা রোপন করা হতো জমিতে।
আর প্রতি ধানের গোছে দেয়া হতো সাত থেকে আটটি চারা। তবুও ধানের গোছা তেমন একটা ভালো হতো না। ফলে ধানের শীষও কম বের হতো। যে কারণে ফলন কম হতো। কিন্তু এবার যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের কারণে ২০ থেকে ২৫ দিনে চারা লাগানো সম্ভব হয়েছে। জমিতে চারা রোপণের সময় গোছ প্রতি দুই থেকে তিনটা ধানের চারা ব্যবহার করা হয়েছে। চারা রোপনের ৫০ দিন পর ধানের গোছার যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে প্রতিটি ধানের গোছেই বের হবে শীষ। ফলনও হবে আশানুরূপ। কৃষক শংকর কুমার মৈত্রের মতো একই গ্রামের মোট ৭০ জন কৃষক ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় বোরো ধানের সমলয় চাষাবাদে ১৫০ বিঘা জমিতে ‘ব্রি ধান- ৯২’ জাতের ধান যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে চাষাবাদ করছেন।
ট্রেতে বীজ ববন থেকে শুরু করে, মেশিনে ধানের চারা রোপন করা, ধান কাটা, মাড়াই ঝাড়াই থেকে সংগ্রহ সবই হবে যন্ত্রের সাহায্যে। উপজেলা কৃষি অফিস ৭০ জন ধান চাষিকে ৬০০ কেজি বীজ, ৪৫০০ কেজি ইউরিয়া সার, ২০০০ কেজি ডিএমপি সার ও ২৫০০ কেজি এমওপি সার সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বিতরণ করে। কালীগঞ্জ উপজেলায় সর্বপ্রথম যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ধান চাষ করে কৃষকরা উল্লেখযোগ্য হারে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন বলে মনে করছেন স্থানীয় কৃষি অফিস। ৩৩ শতকে বিঘা হিসেবে ধানের চারা উৎপাদনের খরচ (বীজের মূল্য বাদে) ২০০০ টাকা পূর্বে খরচ হলেও সমলয় চাষাবাদে তা মাত্র ৭০০ টাকা। জমি প্রস্তুতে (২-৪টি চাষ) পূর্বের খরচ ২৫০০ টাকা সমলয়ে তা ১৫০০ টাকা। ধান চাষের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সার প্রয়োগে পূর্বে ৫০০০ টাকা লাগলেও সমলয়ে ধান চাষের এ খাতে খরচ মাত্র ২২০০ টাকা। ধানের চারা রোপণের পূর্বে ১৮০০ টাকা খরচ হলেও সমলয়ে তা ১০০০ টাকা।
ধান খেতে নিড়ানীসহ আন্তঃপরিচর্যা পূর্বে ২০০০ টাকা হলেও সমলয়ে তা ১৮০০ টাকা। ধানে সেচ খরচ পূর্বে ২০০০ টাকা সমলয়ে তা ১৫০০ টাকা। ফসল কাটা, সংগ্রহ, মাড়াই, ঝাড়ায়সহ পূর্বে ৬০০০ টাকা খরচ হলেও সমলয়ে তা মাত্র ২৫০০ টাকা। তাহলে দেখা যায়, ১ বিঘা জমিতে সনাতন পদ্ধতিতে ধান চাষ করলে খরচ হয় ২১,৩০০ টাকা। আর যন্ত্রের মাধ্যমে ধান চাষ করে খরচ হয় মাত্র ১১,২০০ টাকা। এক্ষেত্রে সমালয় চাষাবাদে কৃষকের বিঘা প্রতি খরচ সাশ্রয় হবে ১০,১০০ টাকা। ১৫০ বিঘা জমিতে সনাতন পদ্ধতিতে ধান চাষ করলে খরচ হতো ৩১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। আর আধুনিক পদ্ধতিতে যন্ত্রের মাধ্যমে একই পরিমাণ জমিতে ধান চাষে খরচ হবে ১৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ১৫০ বিঘা জমিতে আধুনিক পদ্ধতির যান্ত্রিক চাষাবাদে কৃষকের ১৫ লাখ ১৫ হাজার টাকা সাশ্রয় হবে। অন্যদিকে, সনাতন পদ্ধতিতে ১৫০ বিঘাতে ৩৭৫০ মণ আর আধুনিক যান্ত্রিকীরণের মাধ্যমে একই পরিমাণ জমিতে ধান উৎপাদন হবে ৪৫০০ মণ।
অর্থাৎ ৭৫০ মণ ধান বেশি উৎপাদন হবে আধুনিক যান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহারে। আর উৎপাদিত ৭৫০ মণ ধানের সম্ভাব্য বাজার মূল্য প্রায় ১১ লাখ টাকা। উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি অফিসার তোফায়েল আহমেদ বলেন, উপজেলায় প্রথমবারের মতো যান্ত্রিকীকরণ পদ্ধতিতে শুরু হওয়া ধান চাষে কৃষকের বেশ আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। আধুনিক এ পদ্ধতিতে ধান লাগানো এবং কাটার সময় শ্রমিক সংকট দূর করবে যন্ত্র। সমলয় প্রকল্পের মাধ্যমে ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রে ধান লাগিয়ে কৃষকের শ্রমিক খরচ কম হওয়ায় তারা খুব খুশি। আশা করছি সমলয় আওতায় থাকা কৃষকরা এ পদ্ধতিতে বেশ লাভবান হবেন। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আখতারুজ্জামান মিয়া বলেন, শ্রমিক ছাড়া যন্ত্রের মাধ্যমে কম সময়ে অধিক উৎপাদনের মধ্য দিয়ে সমলয়ের কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন। আধুনিক যান্ত্রিকীকরণের এই পদ্ধতি এখানকার কৃষকদের মধ্যে আগ্রহ, উৎসাহ ও উদ্দীপনা বাড়িয়েছে। আশা রাখছি সামাজিকভাবেও এ পদ্ধতি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুব আলম রনি বলেন, কৃষিতে আধুনিকতার পরশ লাগাতে উপজেলা ১৫০ বিঘা জমিতে এবারই প্রথম যান্ত্রিক পদ্ধতিতে বোরো ধানের আবাদ হচ্ছে সমলয় প্রকল্পে। উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে এ প্রকল্পের আওতায় থাকা কৃষকদেরকে আমরা সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছি। আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে চাষাবাদ করলে লোকসান গুণতে হবে না, বরং কৃষক দেখবে লাভের মুখ।