পবিত্র মক্কা শহর ইসলামের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র। সপ্তম শতকের শুরুর দিকে এখানেই মহানবী (সা.) আল্লাহর বাণী লাভ করেন। সেখানে আছে পবিত্র তীর্থ বাইতুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর ঘর; যা আমরা কাবা শরিফ হিসেবে জানি। হাজরে আসওয়াদ মূলত পাথরের একটি একক অংশ ছিল; তবে আজ বেশ কয়েকটি টুকরো নিয়ে গঠিত; যা একসঙ্গে সিমেন্ট করা বা জোড়া দেয়া হয়েছে। এগুলো একটি রুপালি ফ্রেমে বেষ্টিত। যা কাবার বাইরের দেওয়ালে রুপার নখর দ্বারা বাঁধা। কাবার দক্ষিণ-পূর্বকোণে একটি খাঁটি রুপার ফ্রেমে হাজরে আসওয়াদ লাগানো।
হাজরে আসওয়াদ একটি কালো রঙের প্রাচীন পাথর; যা মাতাফ থেকে দেড় মিটার (চার ফুট) উঁচুতে অবস্থিত। আদম (আ.)-এর সময়কালের বলে কালো পাথরের উল্লেখ করা হয়। আবার অন্য সূত্র বলে, ইবরাহিম (আ.) কাবা নির্মাণকালে ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে পাথরটি পান। অবশ্য অনেক বিজ্ঞানী একে উল্কাপি- বলে উল্লেখ করেছেন। চতুর্ভূজ আকৃতির এ স্থাপনা ইবরাহিম (আ.) ও তার ছেলে ইসমাইল (আ.) নির্মাণ করেন। হজের সময় তীর্থযাত্রীরা এ স্থাপনার চারিদিকে প্রদক্ষিণ করেন। এসময় তারা হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ বা চুম্বন করে থাকেন।
সাদা থেকে কালো : হাদিস গ্রন্থগুলোতে হাজরে আসওয়াদ সম্পর্কে প্রচুর আলোচনা এসেছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হাজরে আসওয়াদ একটি জান্নাতি পাথর। এর রং দুধের চেয়ে বেশি সাদা ছিল। এরপর বনি আদমের পাপরাশি এটিকে কালো বানিয়ে দিয়েছে।’ (তিরমিজি : ৮৭৭, মুসনাদে আহমদ : ১/৩০৭-৩২৯)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘হাজরে আসওয়াদ জান্নাতেরই একটি অংশ।’ (সহিহ ইবনে খোজায়মা : ৪/২২০)। কিছু কিছু বর্ণনায় পাওয়া যায়, পাথরটি একসময় সাদা ছিল; কিন্তু মানুষের স্পর্শ ও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার কারণে কালো হয়ে গেছে; যা মানুষের পাপকে প্রতিফলিত করছে। এমনটা বলেন বিজ্ঞানী আল আফিত। তার মতে, নতুন ছবি থেকে বোঝা যায়, ধর্মে বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
হাজরে আসওয়াদ চুম্বন : কাবাঘর তওয়াফ এবং প্রদক্ষিণের সময় হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ ও চুম্বন করা সুন্নত। মুসলিম নর-নারীর কাছে এ পাথর অতি মূল্যবান। বাইতুল্লাহ তওয়াফের সময় হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের বিধান থাকলেও ভিড় ঠেলে ভীষণ কষ্ট স্বীকার করে সরাসরি চুম্বন করতেই হবে, বিষয়টি এমন নয়। তবে করতে পারলে ভালো। যদি সরাসরি চুম্বন করা সম্ভব না হয়, তাহলে ডান হাত দিয়ে ইশারা করলেও হবে। অর্থাৎ হাজরে আসওয়াদের দিকে হাত সম্প্রসারিত করে নিজ হাতে চুম্বন করলেও সুন্নত আদায় হয়ে যাবে।
এতে আল্লাহতায়ালা হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের বরকত দান করবেন। প্রতি চক্করে হাজরে আসওয়াদ বরাবর এসে সরাসরি বা ইশারায় চুমু খাওয়ার সময় ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলা চাই। রাসুল (সা.) তওয়াফের মধ্যে যখনই হাজরে আসওয়াদের কাছে আসতেন, তাকবির তথা আল্লাহু আকবার বলে চুমু দিতেন বা লাঠি ইত্যাদি দিয়ে ইশারা করতেন। কিন্তু বিসমিল্লাহ বলাটা মারফু হাদিসে না থাকলেও আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে সহিহ সনদে বর্ণিত আছে, তিনি ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে হাজরে আসওয়াদে চুমু দিতেন। (বোখারি : ১/২১৯, মুসান্নাফে আবদির রাজ্জাক : ৫/৩৩)।
চুম্বনের ফজিলত : শরিয়তে মর্যাদাপূর্ণ এ পাথরে সরাসরি বা ইশারার মাধ্যমে চুমু দেওয়ার বিধান রয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, এ দুটি রোকন (হাজরে আসওয়াদ ও রোকনে ইয়ামানি) স্পর্শ গোনাহগুলো মুছে দেয়। (তিরমিজি : ৯৫৯)।
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘কেয়ামতের দিন তার একটি জিহ্বা ও দুটি ঠোঁট থাকবে। বাইতুল্লাহর জিয়ারতকারীরা কে কোন নিয়তে তাকে চুম্বন করেছে, সে সম্পর্কে সাক্ষ?্য দেবে।’ (সহিহ ইবনে খোজায়মা : ৪/২২১, মুসতাদরাকে হাকেম : ১/৪৫৭)। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-কে হাজরে আসওয়াদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে তা স্পর্শ ও চুম্বন করতে দেখেছি।’ (মুসলিম : ১২৬৭)।
আসওয়াদের ঐতিহাসিক তথ্য : ইসলামপূর্ব কোরাইশদের যুগে কাবা শরিফের গিলাফ যখন পুড়ে গিয়েছিল, তখন হাজরে আসওয়াদও পুড়ে গিয়েছিল। ফলে তার কৃষ্ণতা আরও বেড়ে যায়। রাসুল (সা.)-এর নবুয়তপূর্ব সময়ে কাবা পুনর্র্নিমাণের পর হাজরে আসওয়াদ আগের স্থানে কে বসাবেন, তা নিয়ে কোরাইশদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেঁধেছিল।
তখন মহানবী (সা.) নিজের গায়ের চাদর খুলে তাতে হাজরে আসওয়াদ রেখে সব গোত্রপ্রধানকে চাদর ধরতে বলেন। গোত্রপ্রধানরা চাদরটি ধরে কাবাচত্বর পর্যন্ত নিয়ে গেলে নবীজি (সা.) নিজ হাতে তা কাবার দেওয়ালে স্থাপন করেন। এভাবে দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটান। আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.)-এর শাসনামলে (৬১-৭১ হি.) হাজরে আসওয়াদ ভেঙে তিন টুকরো হয়ে গিয়েছিল। ফলে তিনি তা রুপা দিয়ে বাঁধাই করেন। তিনিই সর্বপ্রথম হাজরে আসওয়াদকে রুপা দিয়ে বাঁধানোর সৌভাগ্য অর্জনকারী।
১৭৯ হিজরিতে আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদ হাজরে আসওয়াদকে হিরা দিয়ে ছিদ্র করে রুপা দিয়ে ঢালাই করেন। ৩১৭ হিজরিতে কারামতিয়ারা হারাম শরিফে অতর্কিত আক্রমণ করে হাজরে আসওয়াদ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পরে ৩৩২ হিজরিতে ফিরিয়ে এনে চুনা দিয়ে তার চারপাশ এঁটে দেয়া হয়। ৪১৩ হিজরিতে এক নাস্তিক লৌহ শলাকা দ্বারা হাজরে আসওয়াদের ওপর হামলে পড়ে। ফলে তা ছিদ্র হয়ে যায়।
এরপর বনি শাইবার কিছু লোক তার ভগ্নাংশগুলো একত্রিত করে কস্তুরি দ্বারা ধুয়ে তার টুকরোগুলো আবার জোড়া লাগায়। ১৩৩১ হিজরিতে সুলতান মুহাম্মদ রাশাদ হাজরে আসওয়াদের চারপাশে রুপার একটি নতুন বেষ্টনী তৈরি করে দেন। ১৩৫১ হিজরির এপ্রিলের ১৮ তারিখে বাদশাহ আবদুল আজিজ বিশিষ্ট ব্যক্তি ও আলেমণ্ডওলামাসহ কাবা শরিফে উপস্থিত হন। হাজরে আসওয়াদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য তাতে মেশকে আম্বরের মতো মূল্যবান পাথর সংযুক্ত করেন। অবশেষে ১৪১৭ হিজরিতে পবিত্র কাবাঘরের সঙ্গে হাজরে আসওয়াদেও বিশেষ রুপার দ্বারা নতুন বেষ্টনী স্থাপিত হয়।
হাজীদের করণীয় : বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলিম উম্মাহ কাবা শরিফে হজ পালন করতে আসেন। প্রায় সবারই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন। কিন্তু হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ ও চুম্বনের মুহূর্তে বেশকিছু অসতর্কতা পরিলক্ষিত হয়। যা নিতান্তই অক্ষমার্হ। কারও জবরদস্তিমূলক চুম্বন বা স্পর্শের চেষ্টার ফলে যেন অন্য কোনো মোমিনের ক্ষতি না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
অন্য কেউ যেন মনে আঘাত না পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। গোনাহ মাফ করাতে গিয়ে যেন আরও গোনাহের বোঝা মাথায় করে ফিরতে না হয়, খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, এমনটা হলে ফলাফল হিতে বিপরীত হবে। প্রবল আবেগের বশীভূত হয়ে ছোট্ট একটি পাথরের ওপর শত শত মানুষ একসঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
ফলে কারও নাক ফাটছে, কারও হাত ভাঙছে, কারও পা ভাঙছে। আবার কেউ শ্বাসরোধে অবলীলায় মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে গোনাহ মাফ করাতে এসে অন?্যকে কষ্ট দিয়ে অজান্তেই আরও গোনাহের বোঝা মাথায় করে দেশে ফেরার চেয়ে চুম্বন না করাই শ্রেয় নয় কি? কোরআনে কারিমে অপর ভাইকে কষ্ট দেওয়ার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি এসেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যেসব লোক বিনা দোষে মোমিন নর-নারীকে কষ্ট দেয়, তারা অতি বড় একটা মিথ্যা অপবাদ ও সুস্পষ্ট গোনাহের বোঝা মাথায় তুলে নেয়।’ (সুরা আহজাব : ৫৮)। মানুষকে নিরপরাধে কষ্ট দেয়া ইসলাম কোনোভাবেই সমর্থন করে না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সে-ই প্রকৃত মুসলমান, যার জিহ্বা ও হাতের অনিষ্টতা থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে। আর যে আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজসমূহ পরিত্যাগ করেছে, সে-ই প্রকৃত মুহাজির।’ (বোখারি : ১০)। যে ব্যক্তি তার আচরণে অন?্যকে কষ্ট দেয়, তার ঠিকানা জাহান্নাম। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি দোজখ থেকে মুক্তি ও জান্নাত লাভ করতে চায়, সে যেন মানুষের সঙ্গে এমন ব্যবহার করে, যে ব্যবহার সে নিজে অন্যের কাছে আশা করে।’ (মুসলিম : ১৫৬৬)।
হজ ধৈর্যপরীক্ষার এক মোক্ষম স্থান। আমরা যেন পেশিশক্তির অপপ্রয়োগ না করি। অনুগ্রহ, সম্মান ও সহানুভূতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করা চাই। তাহলে ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, দুর্বল-সবল নির্বিশেষে হাজরে আসওয়াদ তথা কালো পাথরের স্পর্শ এবং চুম্বনে ধন?্য হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করা যাবে। নিজেদের গোনাহ মুক্ত করতে সক্ষম হবো। সওয়াবের একটা অংশ সাহায্যকারীর আমলনামায়ও লেখা হবে।