ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু

চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু

দিন নেই রাত নেই, ঘরে কিংবা বাইরে, বাসা কিংবা অফিস সব জায়গাতেই মশার তাণ্ডব। ক্ষুদ্র এ পতঙ্গের যন্ত্রণায় রীতিমতো অতিষ্ঠ নগরবাসী ও আতঙ্কে দেশবাসী। শুধু রাত নয়, দিনেও কয়েল জ্বালাতে হয় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। ওষুধ বা স্প্রে, কিছুতেই ঠেকানো যায় না মশার উপদ্রব। যতই দিন যাচ্ছে, ততই বাড়ছে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব। ফলে নতুন করে চোখ রাঙানোর অপেক্ষায় ডেঙ্গু। এ চিন্তায় যেন ঘুম হারাম সবার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার তথ্য বলছে, সাধারণত জুন থেকে ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হয়। কারণ, এ সময়ে বর্ষাকালের শুরু। বৃষ্টির পানি বিভিন্ন স্থানে জমে থাকে। এর প্রাদুর্ভাব চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তাই এ সময়টাকে ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার প্রজননকাল ধরে নেওয়া হয়। এই ডেঙ্গু থেকে রাজধাণীবাসীসহ দেশবাসী কেউই নিরাপদ নয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকার দুই সিটির বেশ কিছু ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট মানদ-ের চেয়ে বেশি। এবারও ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। প্রতি বছরে শত কোটি টাকা খরচ করেও রাজধানীবাসীকে মশার কবল থেকে মুক্তি দিতে পারছে না ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। নানা পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়া হলেও সবকিছু ব্যর্থ করে দিয়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে বিস্তার হচ্ছে এডিস মশা।

বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা, শুষ্ক মৌসুমে ধুলার দুর্ভোগ, আর বছরজুড়ে যানজটের ভোগান্তি যেন রাজধানীবাসীর নিত্যদিনের সঙ্গী। এসব ভোগান্তির সঙ্গে মশার উপদ্রবে রীতিমতো অতিষ্ঠ দুই কোটির অধিক জনগণ। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নানা উদ্যোগ, অভিযানসহ নিত্যনতুন কার্যপরিচালনা করেও হার মানতে হচ্ছে মশার কাছে। মশার অত্যাচার থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে পারেনি সংস্থা দুটি।

প্রতি বছর মশার উপদ্রব আর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বারবার ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ দুই সিটির বাসিন্দারা। তারা বলছেন, বছরজুড়ে মশার উপদ্রব ছিল। দিন নেই, রাত নেই মশার অত্যাচার চলছেই। এক জায়গায় ১০ মিনিট বসে থাকা যায় না, ছেঁকে ধরে মশা। দিনের বেলাও বাড়িতে হয় মশারি টানিয়ে না হয় কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হয়। তারা বলেন, বছরজুড়েই শুনতে পাই সিটি কর্পোরেশন এই করছে, সেই করছে। কিন্তু আমরা মশা থেকে মুক্তি পাই না। ঢাকা শহরে নির্দিষ্ট মৌসুমে ডেঙ্গু একটি ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। এত এত টাকা-পয়সা খরচ করে পুরো বছর সিটি কর্পোরেশন কী করে, এটাই বুঝতে পারি না!

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক রাজধানীর এক স্থায়ী বাসিন্দা বলেন, সচরাচর সিটি কর্পোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণকর্মীদের দেখা যায় না। তারা কখন এসে মশার ওষুধ ছিটাই, কিছুই বুঝতে পারি না। খালি এতটুকু বুঝতে পারি মশার যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ঠ। বছরজুড়ে মশা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারেনি ঢাকার সিটি কর্পোরেশন। আমার আত্মীয়-স্বজনসহ আশেপাশের এলাকার অনেককে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে দেখেছি। কিন্তু দেখিনি এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের তৎপরতা। তাদের তৎপরতা শুধু মিডিয়াতে দেখা যায়। বাস্তবে আমরা, সাধারণ এলাকাবাসী ডেঙ্গু বা মশা নিয়ন্ত্রণে তাদের কোনো কার্যক্রম দেখতে পাই না।

সিটি কর্পোরেশনের এত এত পদক্ষেপ, তবুও কেন নিয়ন্ত্রণে আসে না ডেঙ্গু, কেন কমে না মশার উপদ্রব? এ বিষয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একজন অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ বলেছেন, মশা দুই ধরনের। যত দিন সাধারণ মশার সঙ্গে এডিস মশাকে মেশানো হবে, তত দিন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনের আলাদা ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার, যা বছরজুড়ে চলমান থাকতে হবে। থাকতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাশাপাশি এ কাজে জনগণকেও সম্পৃক্ত করতে হবে।

২০০০ সালে প্রথম বাংলাদেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় এবং ৫ হাজার ৫০০ মানুষ আক্রান্ত হয়। এরপর প্রতি বছরই কমবেশি ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হয়েছে, তবে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে ২০১৯ সালে। ওই বছর সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং ১৭৯ জন মারা যায়। এরপর থেকে প্রতিবছরই বহু মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারাও যাচ্ছে অনেকে।

জানামতে, ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটায় ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার দুটি প্রজাতি। যার একটি হলো এডিস ইজিপ্টি, আরেকটি হলো অ্যালবোপিকটাস। এডিস ইজিপ্টিকে শহুরে মশা বা নগরের মশা অথবা গৃহপালিত মশা বলা হয়; আর অ্যালবোপিকটাসকে বলা হয় এশিয়ান টাইগার মশা অথবা গ্রামের মশা। এডিস মশা পাত্রে জমা পানিতে জন্মায় এবং বর্ষাকালে এর ঘনত্ব বেশি হয়। তাই ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব এ সময় বেড়ে যায়।

সূত্রমতে, সারা দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৪৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা যাননি। তবে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩ হাজার ৭৫০ জন। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় ১৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ছয়জনের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্য থেকে এসব জানা যায়। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, ডেঙ্গুতে এই মাসে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ১৭৮ জন এবং এই মাসে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন তিনজন।

সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ৩১৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। যার মধ্যে ঢাকায় ১০১ জন, বাকি ২১৪ জন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এই বছরের জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন এবং এপ্রিলে ৭০১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন এবং এপ্রিলে সাতজন মারা গেছেন।

ডেঙ্গু,মশা,রাজধানী,ঢাকা
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত