ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৬/১)

মানুষের আছে উড়াল দেওয়ার ডানা

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
মানুষের আছে উড়াল দেওয়ার ডানা

আল্লাহর অশেষ দয়া ও মেহেরবানিতে আজ থেকে মসনবি শরিফ ৬ষ্ঠ খণ্ডের গল্প শুরু হচ্ছে। মসনবি শরিফ ৬ খণ্ডে কমবেশি ২৬ হাজার শ্লোক নিয়ে বিন্যস্ত। ফার্সি ভাষায় বিশ্বসাহিত্যের বিস্ময় প্রেমের এ মহাকাব্য রচনা করেছেন মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহ.)। ভাবতেও পারছি না, কীভাবে পাঁচটি খণ্ডের গল্পগুলো দৈনিক পত্রিকার পাঠকদের উপযোগী করে রচনা ও প্রকাশ করা সম্ভব হলো। এর পেছনে দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা, বিশেষ করে ১০ নম্বর পাতার সংবাদকর্মীদের সযত্ন পরিচর্যার জন্য শোকরিয়া জানাচ্ছি। পাঠকদের অজস্র ভালোবাসা না হলে দীর্ঘ চারটি বছর বিরতিহীনভাবে এ সাধনা চালিয়ে যাওয়া লেখকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আলহামদুলিল্লাহ, খুশির সংবাদ হচ্ছে, ধারাবাহিক গল্পের ছয়টি বই ‘মসনবি শরিফের গল্প’ নামে ছায়াপথ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

মসনবি শরিফ গল্পের পর গল্প দিয়ে সাজানো হলেও এটি কোনো গল্পের বই নয়; বরং গল্পের ভাঁজে ভাঁজে আত্মার রহস্য ও আল্লাহপ্রেমের আকর্ষণে মানবমনকে উতলা করাই মাওলানা রুমির লক্ষ্য। এ কারণে যারা গল্পগ্রন্থ মনে করে মসনবি পড়ার ও বোঝার চেষ্টা করেছেন বা মসনবির গল্প নামে বই প্রকাশ করেছেন, তারা হতাশ হয়ে পথ হারিয়েছেন। এ সতর্কতার কারণে এখানে অনেক দীর্ঘ বা ক্ষেত্রবিশেষে চটুল কিছু গল্প উপস্থাপন করা হয়নি। তাছাড়া গল্পগুলো মসনবি শরিফের হুবহু অনুবাদ নয়; বরং বলা যাবে মাওলানার চিন্তা ও মসনবির ভাবধারার সঠিক চিত্রায়ন ও প্রতিফলন। গল্পগুলো পড়লে মূল মসনবি বোঝার যোগ্যতা অর্জিত হবে। আশা করি, আধ্যাত্মিক জগতে উড়াল দেওয়া আর আত্মার নগরমুখী জীবন গড়ার আগ্রহ প্রবল হবে। ৬ষ্ঠ খণ্ডের প্রথম আজকের ছোট গল্পটিও সে লক্ষ্যে নিবেদিত।

এক মাহফিলে বক্তার মুখে খই ফুটছিল। মনে হচ্ছিল, তার চেয়ে দামি বক্তা বুঝি দেশে আর দু’চারজন নেই। ওয়াজের মাঝখানে বিপত্তি ঘটাল এক ব্যক্তির বেখাপ্পা প্রশ্ন, ‘হুজুর! আপনার কাছে আমার একটি প্রশ্ন আছে। এ মজলিসেই সেই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।’ ওয়ায়েজ থমকে গিয়ে জানতে চাইলেন, ‘কী প্রশ্ন?’

বর সরে বারু য়্যকি মুরগি নেশাস্ত

আয সারো আয দুম কুদুমিনাশ বেহ আস্ত

দুর্গের দেয়ালে বসে আছে এক উদাস পাখি

বলুন তো, তার লেজ নাকি মাথা দামি?

মনে করুন, শহরের উপকণ্ঠে দুর্গের দেয়ালের ওপর একটি উদাস পাখি বসে আছে। সেই পাখির লেজ অধিক মূল্যবান নাকি তার মাথা? দুয়ের মধ্যে কোনটি অধিক দামি, বলবেন দয়া করে। এক উদ্ভট আজগুবি প্রশ্ন। তবুও জবাব দিতে হবে হুজুরকে। বিচক্ষণ বক্তা বললেন, ‘আপনার প্রশ্নের জবাব আপেক্ষিক।’

গোফত আগর রুয়াশ বে শহর ও দুম বে দেহ

রুয়ে উ আয দুম্মে উ মি দান কে বেহ

বললেন, যদি হয় মাথা শহরমুখী, লেজ গ্রামের দিকে

সে পাখির মাথা উত্তম নিশ্চিত তার লেজের চেয়ে।

পাখি বসে আছে দেয়ালের ওপর। দেখতে হবে তার মাথা কোনদিকে। যদি মাথা শহরের দিকে হয় আর লেজ গ্রামের দিকে, নিশ্চিত বলা যাবে, তার মাথা লেজের চেয়ে উত্তম। আর যদি লেজটা শহরের দিকে আর মাথা গ্রামের দিকে হয়, তাহলে নিশ্চয় পাখির লেজ মাথার চেয়ে উত্তম।

শহর মানে আত্মার নগরী, যেখানে উন্নত জীবনের আত্মিক সুখশান্তি ও সমৃদ্ধির সব আয়োজন বিদ্যমান। গ্রাম বলতে তুচ্ছ দুনিয়া, বিরান জনপদ। একটি বিষয় লক্ষ কর, পাখি দেয়ালের ওপর সবসময় বসে থাকে না, হঠাৎ উড়াল দেয় তার নীড়ের দিকে। কাজেই দেখতে হবে, তার নীড় কোথায়? আধ্যাত্মিকতার মহানগরীতে নাকি গ্রামের বিরান ভূমিতে, ময়লার ভাগাড়ে?

পাখির ডানা ঝাপটানো দেখে তার মাথা বা লেজের দাম হিসাব করলাম। প্রশ্ন হলো, মানুষের তো ডানা নেই। মাওলানা রুমি বলেন, ডানা অবশ্যই আছে। মানুষের ডানা তার মনের হিম্মত, উচ্চ মনোবল, সংকল্প। পাখি যেভাবে ডানায় ভর করে আকাশের নীলিমায় উড়ে বেড়ায়, আহার যোগাড় করে জীবনযাপন করে, মানুষও তার হিম্মত ও সংকল্পের ওপর নির্ভর করে সামনে এগিয়ে চলে।

এখানে মানুষের ব্যক্তিসত্তা পরিমাপের একটি নতুন মানদ- দিলেন মাওলানা রুমি। তিনি বলেন, মানুষের বাহ্যিক কাজকর্ম ভালো হোক বা মন্দ, তার ভিত্তিতে চূড়ান্ত বিচার করা যাবে না; বরং কারো ব্যক্তিত্ব মূল্যায়নের জন্য দেখতে হবে তার হিম্মত, উদ্যম ও সংকল্প। বিষয়টি বোঝার জন্য কয়েকটি উপমা দিয়েছেন তিনি।

সাদা রঙের বাজপাখি বড় দামি। ক্ষিপ্র গতির শিকারি বাজের মর্যাদা শাহি প্রাসাদে। কিন্তু যদি উড়ন্ত বাজ মাটিতে নেমে ইঁদুর শিকার করে, সে হবে তুচ্ছ, অধম, নিকৃষ্ট। মানুষও যত নামিদামি হোক, চলনে-বলনে, পোশাকে-আশাকে যতই লেফাফা-দুরস্ত হোক, যদি হীন স্বভাবের, অলস ও মনোবলহীন হয়, সে তুচ্ছ; মানুষ নামে আখ্যায়িত হওয়ার অনুুপযুক্ত। পক্ষান্তরে কোনো পেঁচারও ধ্যানজ্ঞান যদি হয় বাদশার দরবার, সে নিশ্চয় বাজপাখির চেয়ে উত্তম। তুমি কারো মাথার টুপি, মুকুট, লেবাস, বাহ্যিক অবয়ব দেখে বিচার করো না। মূল্যায়ন করতে হবে প্রত্যেকের চেতনা, চিন্তা মনোবল ও সংকল্প দেখে। এ তত্ত্বটি বোঝার জন্য মানুষের স্বরূপ দেখ-

আদমি বর কদ্দ য়্যক তশতে খমির

বর ফুরুযাদ আয আসেমান ও আয আসির

মানুষ যদিও অবয়বে এক তশতরি খামিরে গড়া

কিন্তু মান-মর্যাদায় ঊর্র্ধ্ব-আকাশ নক্ষত্রলোকের সেরা।

মানুষ দেখতে এক অসহায় প্রাণী। তার চেয়ে শক্তিশালী অগণিত জীবজন্তু আছে। কিন্তু তার বাতেনি পরিচয়, প্রকৃত মর্যাদা আসমানগুলো ও নক্ষত্রমণ্ডলিকে ছাড়িয়ে যায়। তার প্রমাণ, আসমান তার এত উচ্চতা, নক্ষত্ররাজির জলসা, আলো ঝলমল তারকার মেলা হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন সম্বোধন লাভ করেনি, যে সম্বোধন মানুষ লাভ করেছে। বেহেশত থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল মানুষকে। এ কারণে তার দুঃখ-দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। এরপরও আল্লাহ মানুষকে সম্মানিত করে বলেছেন, ‘আমি তো আদমসন্তানকে মর্যাদা দান করেছি; স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি; তাদেরকে উত্তম রিজিক দান করেছি। আমি যাদেরকে সৃষ্টি করেছি, তাদের অনেকের ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৭০)।

আসমান ও জমিনের এমন উচ্চতা, বিশালতা সত্ত্বেও কেউ কি বলেছে, আসমান তুমি কত সুন্দর ও উজ্জ্বল! হে পৃথিবী, কত বিস্তৃত তোমার জ্ঞান ও বিদ্যার বহর! ওহে আসমান ও জমিন, তোমাদের মনোবল কত উন্নত, সুদূর প্রসারী? আসমান বা জমিনকে সম্বোধন করে এমন কথা কোনো পাগলও বলবে না। কারণ, সবাই জানে, আসমান ও পৃথিবীর মাটি যতই বিশাল বিস্তৃত হোক, উপরিউক্ত পরিভাষা বোঝার শক্তি ওদের দেওয়া হয়নি। ওদের নিজস্ব দৃষ্টিশক্তি, চেতনা ও মনোবল নেই।

আরেকটি উপমা নাও। তুমি কি নিজের সুন্দর গড়ন, পরিপাটি পোশাক নিয়ে হাম্মামের বাইরে দেয়ালে অঙ্কিত কোনো রূপসীর নকশার সামনে গিয়ে বলেছ, দেখ তো আমাকে কেমন সুন্দর দেখায়! তার চেয়ে তুমি কোনো বুড়ির কাছে গিয়ে নিজেকে উপস্থাপন করাকে অগ্রাধিকার দেবে, তার মতামত জানতে চাইবে। এর কারণ, তুমি জান যে, দেয়ালে অঙ্কিত ছবির প্রাণ নেই, বোঝার শক্তি নেই। পক্ষান্তরে একজন মানুষ অশীতিপর বৃদ্ধা হলেও তার প্রাণ আছে, বোধশক্তি আছে।

কাজেই বুঝে নাও, মানুষের মূল্যমান তার বাহ্যিক চেহারা ও লেবাস-পোশাকের ভিত্তিতে নয়, বরং প্রাণের মানদ-েই মানুষের মর্যাদা নির্ণিত হয়। রূপসী সুন্দরীর লাশের সঙ্গে তুমি ঘুমাতে রাজি হবে না, তার চেয়ে জীবিত বৃদ্ধা নারীকেও অগ্রাধিকার দেবে। কারণ, তুমি জান, রূপসীর লাশের প্রাণ নেই, আর বুড়ির প্রাণ আছে।

এখন প্রাণের পরিচয় দিই। প্রাণের একটি পরিচয় জীবাত্মা, তা সব প্রাণীর আছে। মানুষের যে প্রাণ আছে, তা জীবাত্মার চেয়ে অধিক। তাকে প্রাণ না বলে আত্মা বলাই উত্তম। কোরআন ও হাদিসের ভাষায় রুহ। রুহ জীবনের ভালো বা মন্দ কী, সে তা চেনে। কোনো সৎকর্ম সম্পাদন করলে বা কারো প্রতি অনুগ্রহ দেখাতে পারলে রুহ খুশি হয়। কোথাও ক্ষতির সম্মুখীন হলে অনুতাপ-অনুশোচনায় কাঁদতে থাকে। তাতে বোঝা যায়, প্রাণের বা রুহের মূল রহস্য হচ্ছে সচেতনতা।

যার মধ্যে চেতনা নেই, তাকে আমরা বলি মৃত। এর একটি হিসাব হলো, যে ব্যক্তি অধিক সচেতন, সে অধিকতর প্রাণবান। যার চেতনা সবচেয়ে প্রবল, তার প্রাণ বা রুহ অপেক্ষাকৃত বিরাট ও পূর্ণাঙ্গ। বস্তুত প্রাণের তথা মানুষের মূল্যমান নির্ণিত হয় তার প্রাণের সচেতনতার আদলে। অন্যকথায়, রুহ ও প্রাণের প্রভাব প্রকাশ পায় প্রাণের সচেতনতার নিরীখে। এ কারণে যে লোক যত অধিক সচেতন, তার মর্যাদা তত অধিক। সচেতন প্রাণই ধাপে ধাপে আল্লাহর পরিচয় লাভে ধন্য হয়।

মাওলানা রুমি আরেকটি তত্ত্বকথার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আমরা যে জগতে বাস করছি, তার বাইরেও জগত আছে। পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে যে জ্ঞান আহরিত হয়, তার বাইরে আরও ঊর্ধ্বে অন্য জগত আছে। সেই জগত হলো দুনিয়ার জ্ঞানের সূতিকাগার।

জৈবিক প্রাণের সেখানে যাওয়ার শক্তি নেই। যে প্রাণ সেই জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে, তাকে আমরা বলি আত্মা বা রুহ। মর্ত্যজগতের প্রাণ অনেকটা জড়বস্তুর মতো। মর্ত্যজগতের প্রাণের গতি খাওয়া-দাওয়া, সুখ-সম্ভোগ, আনন্দ-ফূর্তি পর্যন্ত। আর ঊর্ধ্বজগতের প্রাণ, আত্মা কিংবা রুহের গতি আল্লাহর আরশ পর্যন্ত। মানুষ ছাড়া আর কাউকে দেননি আল্লাহ এ প্রাণ। মুহাম্মদ (সা.) সেই প্রাণের দিশারী, সুপারিশকারী। তিনি এ জগতে মানবাত্মাকে দ্বীনের দিকে ডাকতে থাকেন। আর সেই জগতে আহ্বান জানান বেহেশতের দিকে। এ জগতে তিনি আল্লাহর কাছে বলেন, তুমি বান্দাদের সরল সহজ পথে চালাও। ওই জগতে তিনি বলেন, হে আল্লাহ! তোমার রূপের ছটায় বান্দাদের মুগ্ধ ও আপ্লুত কর।

[ সূত্র : মাওলানা রুমির মসনবি শরিফের গল্প : ৬ষ্ঠ খণ্ড, বয়েত ১২৯-১৭০। ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন : ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI ]

মওলানা রুমি,মসনবি শরিফ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত