ইসলাম সব যুগের সব দেশ ও জাতির জন্য আল্লাহর দেওয়া জীবনবিধান। এটি নির্ভুল ও অপরিবর্তনীয়। তবে আরব দেশে নাজিল হওয়া আরবি ভাষায় বর্ণিত এ বিধান পৃথিবীর প্রতিটি দেশে নিজ নিজ ভাষা ও আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটে একেকটি নিজস্ব কৃষ্টি ও তামাদ্দুন সৃষ্টি করেছে। এর প্রথম উদাহরণ পারস্য দেশ। হোমণ্ডআরাধ্য এ জাতির মধ্যে ইসলামের প্রবেশ ঘটে ওমর (রা.)-এর যুগে। সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের ন্যায় একজন প্রসিদ্ধ সম্মানিত সাহাবি এ দেশটিতে দীর্ঘদিন শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি ও তার সঙ্গে অবস্থানরত সৈনিক ও কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সাহচর্যে ইসলামের প্রায় ঊষালগ্নে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের শিক্ষা ও ইসলামি জীবনযাপন পদ্ধতির বাস্তব প্রশিক্ষণ পারস্যবাসী লাভ করে। অধিকন্তু সে যুগে পারস্য ছিল পৃথিবীর স্বল্প সংখ্যক জ্ঞান-গরিমায়, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে, চিন্তা-চেতনায়, ধনে-মানে উচ্চতম পর্যায়ের আলোকিত জাতিদের অন্যতম।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের স্বর্গীয় পরশে তাই তাদের মাঝে জেগে উঠল সাদি, হাফেজ, রুমি, জামি, নেজামি, ফেরদৌসি, ওমর খৈয়ামের মতো জগত প্রসিদ্ধ মহামানব। যাদের সুবাসে মুগ্ধ হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, কবিগুরু গ্যাটের মতো বিশ্বমান্যজনরা। গিরিশচন্দ্র যখন প্রথম পবিত্র কোরআনের আয়াতগুলো বাংলা ভাষায় অনুবাদ শুরু করেন, তখন কোরআন নাপাক করার অজুহাত দেখিয়ে দেশের আলেম সমাজ তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে তা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়। বিশেষ করে, মুসলমানের ছেলে নজরুল ইসলামের কাব্যে কোরআনের আমপারা বাংলা অনুবাদের মাধ্যমে। মাওলানা জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি (রহ.) পৃথিবীর সর্বত্র আলেম সমাজের মাঝে জনপ্রিয় মুখ্যত তার পবিত্র গ্রন্থ ‘মসনবি শরিফ’-এর জন্য। শুধু একটি গ্রন্থ একজন লেখককে বিশ্ববিখ্যাত করতে পারে, এমন নজির বিরল। এ মহাগ্রন্থের মূল্যায়নও হয়েছে তেমনই অতুলনীয় পর্যায়ে। মুসলিম বিশ্বের আলেম সমাজ একে ফার্সি ভাষায় ‘কোরআন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। একটি গ্রন্থের এর চেয়ে বড় প্রশংসা আর কী হতে পারে?
আমাদের দেশে শিক্ষিত সমাজের এক বড় সমস্যা হলো, যারা আরবি, ফার্সি, উর্দু ভালো জানেন, তারা বাংলা-ইংরেজি ভালো জানেন না। অবশ্য বর্তমান সময়ে এ সমস্যা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। তবে এতে ভালোমন্দ উভয় দিক লক্ষ্যণীয়। কোনো কোনো সময়ে তাতে অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী হয়ে যায়। মসনবি শরিফের সব বক্তব্য ও উপদেশাবলি বিভিন্ন গল্পের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। একবার কোনো এক মাদ্রাসার ‘অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী’ ছাত্র মসনবি শরিফকে অশ্লীল গ্রন্থ বলে আখ্যায়িত করে নিজ জ্ঞানের বাহাদুরী প্রদর্শন করেছিল। আসলে মসনবির গূঢ়তত্ত্বে পৌঁছাতে তখন তার অনেক পথ বাকি ছিল। শাহ সুফি মাওলানা আবদুল জব্বার (রহ.) তখনও বেঁচেছিলেন। তিনি ছিলেন শান্তশিষ্ট প্রকৃতির মানুষ। এ কথাটি শুনে তিনি অনবরত সাতদিন মেজাজে ছিলেন। বারবার বলছিলেন, সে এর কী বোঝে। মসনবি শরিফ বোঝা কি তার কাজ?
এ ঘটনার প্রেক্ষিতে বায়তুশ শরফের প্রবাদপ্রতিম মেধাবী আলেম, আলিয়া নেসাবের সমাপনী পরীক্ষায় তৎকালীন সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে প্রথম স্থান অধিকারী মাওলানা কুতুব উদ্দিন মন্তব্য করেছিলেন, মসনবি শরিফের শিক্ষা নিতে হলে আমার হুজুরের ন্যায় শিক্ষক আর আমাদের মতো ছাত্র হতে হবে। একটি প্রসিদ্ধ আধ্যাত্মিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ দুজন মনীষীর এ ছিল মসনবি শরিফ সম্পর্কে মূল্যায়ন।
বর্তমানে একজন বিরল ব্যক্তিত্ব মসনবি শরিফকে পদ্য ও গদ্যে বাংলায় অনুবাদ করে আমাদের দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার কঠিন কাজটি সমাধা করেছেন। ভাষার ওপর জ্ঞান থাকাটাই এ কাজের জন্য একমাত্র পূর্বশর্ত নয়। রচনার প্রকাশ-প্রকটনের অন্তর্নিহিত প্রতিভাও এ উদ্যোগে বড় প্রয়োজন। এসব গুণে গুণান্বিত ব্যক্তি আলহাজ ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী। তার এ মহৎ উদ্যোগের প্রতিফলে আমার মতো স্বল্পজ্ঞানী মানুষও মসনবির সৌরভে মুগ্ধ। তাতে অনুবাদকের জ্ঞানের গভীরতা ও প্রকাশের ভঙ্গিমার বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে অনুধাবনীয়। আমি অনুবাদককে বাংলার ফিটজেরান্ড বলে আখ্যায়িত করার ধৃষ্টতা দেখালাম। ব্যক্তিগত জীবনে তার এ সাধনা একই সঙ্গে দেশ, সমাজ ও দ্বীনের সেবা হিসেবে গণ্য হবে, পথ দেখাবে। এমন সব্যসাচী ব্যক্তিত্বের আমি দীর্ঘ সুন্দর সুখীজীবন কামনা করছি।
অনুবাদকের জন্ম চট্টগ্রামের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যসমৃদ্ধ লোহাগাড়ায়। শিক্ষা গ্রহণ করেছেন ঐতিহাসিক শিক্ষানিকেতন চুনতি মাদ্রাসায় এবং চট্টগ্রামের বাতিঘর হিসেবে চিহ্নিত দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসায়; তারপর প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সবখানে শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চাকালে অসাধারণ মেধার পরিচয় দেন তিনি। এরপর কোনো এক সময়ে বিপ্লবোত্তর ইরানে রাষ্ট্রীয় সফর ও সেখানে রেডিও তেহরানে চাকরির সুবাদে ইরানি গুলবাগের নির্যাস ধারণ করলেন নিজের মাঝে। সে নির্যাসে সুরভিত করলেন বাংলার সবুজ বাগিচা। তার এ অবদান বাংলার বিদগ্ধ সমাজে অক্ষয় হয়ে থাকুক। অনুবাদকের এ অসাধারণ কর্ম, তার তীক্ষ্ম মেধা ও অদম্য অধ্যবসায়ের সুস্পষ্ট পরিচায়ক। যা সাধারণের মাঝে তার অসাধারণত্ব পরিস্ফুট করছে স্বকীয় আলোকে।