মুসলমানদের দুটি ঈদ- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহাকে ‘কোরবানির ঈদ’ বা ‘বকরা ঈদ’ বলা হয়। কোরবানির ঈদে বিত্তবানদের ওপর পশু কোরবানি করা ওয়াজিব। আল্লাহতায়ালা রাসুল (সা.)-কে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘আমি অবশ্যই তোমাকে কাউসার দান করেছি। সুতরাং তুমি তোমার রবের উদ্দেশে নামাজ পড় ও কোরবানি কর।’ (সুরা কাউসার : ১-২)। এজন্য নবীজি (সা.) সারা জীবন কোরবানি করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) মদিনার দশ বছরের প্রতি বছরই কোরবানি করেছেন। (তিরমিজি : ১৫০৭)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩১২৩)।
অর্থনীতিতে কোরবানির ব্যাপক ভূমিকা : ধর্মীয় উৎসব জাতীয় অর্থনীতির একটি বিশাল জায়গা দখল করে আছে। ধর্মীয় উৎসবেরও একটি অর্থনৈতিক মূল্য আছে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহাকেন্দ্রিক কোরবানির উদ্দেশ্য বাণিজ্যিক না হলেও অর্থনীতিতে এর ভূমিকা ব্যাপক। কোরবানি উপলক্ষে যে লেনদেন হয়, অর্থনীতিতে তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। কোরবানিতে গরু অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে অর্থের সরবরাহ বাড়ায়। গ্রামের পশু শহরে আসে। শহরের টাকা গ্রামে যায়। বাংলাদেশে কোরবানির ঈদের অর্থনীতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এসময়ে প্রবাসী আয়ও বেশি আসে। আর কোরবানির গরুর উৎপাদন মূলত গ্রামকেন্দ্রিক। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে কোরবানির ঈদ বড় ভূমিকা রাখে।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে কোরবানির প্রভাব : ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘নানা দিক থেকে বিবেচনা করলে এখন কোরবানি ঈদে অর্থনীতির আকর এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ৭৫ হাজার কোটি টাকার হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকের পুরোনো। কারণ, গবাদি পশু ছাড়াও এর সঙ্গে আরও অনেক বিষয় যুক্ত হয়েছে। এখানে মশলার বাজার আছে, কসাইদের আয় আছে, পশু খাদ্যের ব্যবসা আছে। কম হলেও এ ঈদেও মানুষ নতুন পোশাক কেনে।’ তার কথায়, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে কোরবানির পশু এখন ফিক্সড ডিপোজিটের মতো। গৃহস্থ, ছোট ছোট কৃষক চার-পাঁচটি গরু লালন-পালন করে কোরবানির বাজারে বিক্রি করে। এখান থেকে বছরে সে ভালো পরিমাণ অর্থ আয় করে; যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোরবানির গরুসহ গবাদি পশুর মানও ভালো। কারণ, এগুলো যত্ন নিয়ে লালন-পালন করা হয়।’
এক লাখ কোটি টাকার অর্থনীতি : ঈদের অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুঈদ রহমান। তিনি বলেন, ‘আমার বিবেচনায়ও কোরবানি ঈদের অর্থনীতি এখন এক লাখ কোটি টাকার কম হবে না। ঈদসহ যে কোনো উৎসবেই বাংলাদেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। কিন্তু কোরবানির ঈদের বিশেষত্ব হলো, গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়।’
চামড়া রপ্তানির সম্ভাবনা : কোরবানির ওপর ভর করেই সম্প্রসারিত হচ্ছে দেশের চামড়া শিল্প। মোট চামড়ার ৬০ থেকে ৭০ ভাগই সংগৃহীত হয় কোরবানির ঈদে। কোরবানির সময় চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ১ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা জড়িত। লবণ হলো চামড়া সংরক্ষণের অন্যতম উপাদান। কোরবানি উপলক্ষে লবণের ব্যবসাও চাঙ্গা হয়। চামড়া সংরক্ষণে প্রয়োজন হয় বিপুল জনবলের। তখন শ্রমিকরা পান তাদের শ্রমের চড়ামূল্য। দেশের বিভিন্ন স্থানে চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, বাংলাদেশে রপ্তানি খাতে চামড়ার অবস্থান তৃতীয়। জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে ইতালি, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মান, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করা হয়।
মসলার ব্যবসা : কোরবানির পশুর মাংস আমিষ জাতীয় খাদ্যের উপাদান। এটি রান্না করতে প্রায়োজন হয় পর্যাপ্ত নানা মসলা দ্রব্যের। শুধু কোরবানি উপলক্ষে এ ক্ষেত্রে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার মসলার ব্যবসা হয়ে থাকে বলে জানা গেছে।
চামড়া শিল্পের রপ্তানি আয় : বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য অন্যতম পণ্য হলো পশুর চামড়া। অংকে এর পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার। এর অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায় ২০০ কোটি ডলারের। তাই সম্ভাবনা খাত হিসেবে বিবেচনা করে ২০১৭ সালে চামড়াকে ‘বার্ষিক পণ্য’ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। আর্থিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চামড়া শিল্পের রপ্তানি আয় ছিল ১০১ কোটি ৯৮ লাখ ডলার; যা নিঃসন্দেহে অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চামড়া সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক মানদ- নিশ্চিত করা গেলে এবং সরকার এর প্রতি আন্তরিক হলে বছরে পাঁচশ’ কোটি ডলারের চামড়া পণ্য রপ্তানি সম্ভব। এ বৃহৎ শিল্পের অধিকাংশ সংগ্রহই হয়ে থাকে কোরবানির সময়। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে পুরো বছর যে গরু জবাই হয়, এর প্রায় অর্ধেকই হয়ে থাকে কোরবানির সময়। তারা আরও জানিয়েছেন, বছরে মোট চামড়া সংগ্রহ হয় ২২ কোটি বর্গফুট। এর মাঝে ১০ কোটি বর্গফুটই সংগ্রহ হয় কোরবানির মৌসুমে। বিশ্ববাজারে এ দেশের সব ধরনের চামড়ার চাহিদা রয়েছে। বিশ্বে প্রথম শ্রেণির চামড়া ও চামড়াজাত প্রস্তুতকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বে চামড়া খাতে রপ্তানির শতকরা দুই ভাগ হচ্ছে বাংলাদেশের। চর্মজাত সামগ্রী তথা জুতা, স্যান্ডেল, জ্যাকেট, মানিব্যাগ, ওয়ালেট ব্যাগ ইত্যাদি রপ্তানি করে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে। যা সামগ্রিক অর্থনীতিতে বেশ ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে।
চামড়া শিল্পে কর্মরত অগণিত মানুষ : শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সাভারে চামড়া শিল্প নগরীতে প্লটের সংখ্যা ২০৫টি, শিল্প ইউনিটের সংখ্যা ১১৫টি, চালু ট্যানারি সংখ্যা ১২৩টি। এসব প্রতিষ্ঠানে ৬ লাখের অধিক মানুষ কর্মরত। তাদের অর্থনৈতিক জীবন নির্ভর করে এ চামড়া শিল্পের ওপর।
উৎসব অর্থনীতি : বর্তমান সময়ে নানাভাবে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধির জন্য নানা কৃত্রিম উপায় অবলম্বন করা হয়। এর মধ্যে একটি ‘উৎসব অর্থনীতি’। এ উপলক্ষে বিভিন্ন মেলা, পরিদর্শন ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। ঢাকা শহরে বাণিজ্য মেলা, গ্রামীন নববর্ষ মেলা ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। ইসলামে কোরবানি একটি অকৃত্রিম উৎসব অর্থনীতি। এটি যদিও একটি ইবাদত। তবে হজের মতো একে কেন্দ্র করেও যুগে যুগে নানাভাবে উৎসব অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। শুধু গরু বা কোরবানির পশু নয়, শপিং, কেনাকাটা ইত্যাদি অর্থনৈতিক কার্যক্রমও এর মাধ্যমে হয়ে থাকে। যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে। এছাড়া আরও বিভিন্ন দিক থেকে কোরবানির সঙ্গে অর্থনীতির নানা কার্যক্রম জড়িয়ে আছে। সামগ্রিকভাবে যা দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে। আমরা মনে করি, এ খাতে যদি দুর্নীতি, ঘাটে ঘাটে চাঁদা, অনৈতিক দালালি, চামড়া মূল্য সিন্ডিকেট, চামড়া পাচার ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণকল্পে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, তাহলে কোরবানি একটি ‘উৎসব অর্থনীতি’ হয়ে দেশের জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। মনে রাখতে হবে, এসব উপকার কেবলই পার্থিব সংশ্লিষ্ট। পশু কোরবানি একটি নিরেট ইবাদত। এ ক্ষেত্রে এসব অর্থনৈতিক উপকার ও কল্যাণ লাভ কোনোভাবেই মুখ্য নয়। কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরিপূর্ণ ইখলাসের সঙ্গেই এ ইবাদত আঞ্জাম দিতে হবে। কোরবানির উদ্দেশ্যে যারা গরু লালন করবে, বিক্রি করবে, যে যেভাবে এর সঙ্গে যুক্ত হবে, সবার উদ্দেশ্য হতে হবে মানুষকে কোরবানি আদায়ে সহযোগিতা করা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক