সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে এক প্রবাসী বাংলাদেশির সান্ডা খাওয়া-সংক্রান্ত ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। মরু অঞ্চলের এ বিশেষ প্রাণীটি নিয়ে কৌতূহল, মজার মিম ও নানা মতবিরোধ ছড়িয়ে পড়েছে। সান্ডা মূলত গুইসাপ জাতীয় প্রাণী; যাকে আমাদের দেশে অনেকে ‘সান্ডা’ বলি। এটি খাওয়া হারাম নয়। কিন্তু রুচির বিষয়। বোখারির একটি হাদিসে এসেছে, উম্মুল মুমিনিন মাইমুনা (রা.)-এর বাসায় একদিন সাহাবিদের নিয়ে খেতে বসেন নবীজি (সা.)। সে সময় একটি থালায় গুইসাপ ভাজা পরিবেশন করা হয়। প্রথমে বুঝতে না পেরে নবীজি (সা.) হাত বাড়ান। কিন্তু উপস্থিত নারী সাহাবিরা বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, এটা তো গুইসাপ।’ এ কথা শুনে রাসুল (সা.) সঙ্গে সঙ্গেই থেমে যান। বললেন, ‘আমি এটা খাই না। কারণ, আমাদের এলাকায় এটা পাওয়া যায় না। তবে এটা হারাম নয়।’ সান্ডা খাওয়া হালাল; তবে কেউ খাবে কি না, সেটা তার রুচির ওপর নির্ভর করে। ইসলামে এ বিষয়ে কোনো জোর নেই। কেউ না খেলে সেটা নিয়ে বিদ্বেষ, তাচ্ছিল্য বা জোর করার কিছু নেই। আবার কেউ খাচ্ছে বলে তাকে দোষারোপ করা অনুচিত।
ফকিহদের মধ্যে মতবিরোধ : ইসলামি আইন বিশারদদের মধ্যে সান্ডা খাওয়ার বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে। হানাফি মাজহাব অনুসারে, এটি খাওয়া হারাম। কারণ, তারা একে অপবিত্র প্রাণীর অন্তর্ভুক্ত মনে করেন। তারা কোরআনের সুরা আরাফের ১৫৭ নম্বর আয়াতের উদ্ধৃতি দেন, ‘তিনি তাদের জন্য অপবিত্র বস্তুসমূহ হারাম করেছেন।’ তবে মালেকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি মাজহাব অনুসারে, সান্ডা খাওয়া হালাল। কারণ, হাদিসে নবীজি (সা.) এটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেননি এবং সাহাবিরা তা খেয়েছেন। এসব মাজহাবের ফকিহগণ একে খাদ্যোপযোগী প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করেন। বর্তমান সময়ে মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষত সৌদি আরব, কুয়েত ও আরব আমিরাতে এখনও স্থানীয়রা সান্ডা শিকার করে থাকেন। এর মাংস ও তেল নানা উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন। ফলে বিষয়টি শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণেই নয়, সাংস্কৃতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া সান্ডার তেল ব্যবহারের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ও চিকিৎসাগত দিক নিয়েও গবেষণা চলছে। যদিও একে সর্বজনস্বীকৃত চিকিৎসা বলা যায় না, তবু ঐতিহ্যগতভাবে বহু মানুষ একে উপকারী মনে করে আসছে।
ধর্মীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যক্তিগত উপলব্ধি : ইসলামে খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, যা হারাম নয়, তাও কেউ যদি অপছন্দ করেন, তবে তাকে বাধ্য করা হয় না। নবীজি (সা.)-এর উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, কোনো খাবার ধর্মীয়ভাবে বৈধ হলেও ব্যক্তিগত পছন্দ অনুযায়ী কেউ সেটি খেতে না চাইলে তাতে সমস্যা নেই। এটি বর্তমান সমাজেও প্রাসঙ্গিক। যেখানে মুসলমানরা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের খাবারের মুখোমুখি হন। এ ক্ষেত্রে হাদিসের ব্যাখ্যা ও মাজহাব অনুযায়ী ফতোয়ার ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
সান্ডা সংক্রান্ত সমসাময়িক বিতর্ক : সাম্প্রতিক ভাইরাল ভিডিওটির পর সামাজিক মাধ্যমে সান্ডা নিয়ে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ মজার ছলে মিম তৈরি করছেন, কেউ আবার কঠোর সমালোচনা করছেন। এ প্রসঙ্গে আমাদের বোঝা দরকার, ইসলাম শুধু একটি ধর্ম নয়, পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। যেখানে প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে আছে যুক্তি ও দলিল। তাই হাস্যরস বা সমালোচনার বদলে ধর্মীয় জ্ঞানচর্চা ও যুক্তি দিয়ে বিষয়টি বোঝা উচিত। সবশেষে বলা যায়, সান্ডা খাওয়া নবীজি (সা.) নিষিদ্ধ করেননি। তাই একে হালাল বলা যায়। যদিও এটি খাওয়া বা না খাওয়া ব্যক্তিগত রুচির বিষয়।