ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মুসলিম উম্মাহর সংকট উত্তরণে হজের শিক্ষা ও দর্শন

ড. আ.ক.ম. আবদুল কাদের
মুসলিম উম্মাহর সংকট উত্তরণে হজের শিক্ষা ও দর্শন

নৈতিক মূল্যবোধ বিবর্জিত ও ধর্মীয় আদর্শবিহীন বস্তুবাদী সভ্যতা বর্তমানে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। আরবের উসর-ধূসর মরু প্রান্তরে জাহিলিয়াত পরিবেষ্টিত সমাজে মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাব ঘটে। তার ওপর নাজিলকৃত অহির সর্বপ্রথম বাণী হলো ‘ইক্বরা’ পড়! জ্ঞান আহরণ কর। এই বাণীর মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে একদা মুসলিম উম্মাহ জ্ঞানভিত্তিক সভ্যতা বিনির্মাণে অনবদ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়। রাসূল (সা.)-এর পরবর্তী খুলাফা আল রাশিদূন যুগ এবং উমাইয়্যা ও আব্বাসী খিলাফতের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইসলামী সভ্যতা বিশ্বব্যাপী একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়। কিন্তু নানাবিধ কারণে এই সভ্যতা ক্রমে তার অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে।

একাদশ শতাব্দী হতে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমানদের পশ্চাদপদতার সুযোগে ইউরোপীয় সভ্যতা বিকাশ লাভ করতে থাকে। চতুদর্শ শতাব্দীর মাঝমাঝি পর্যন্ত মুসলিম সভ্যতার বিপর্যয়ের সুযোগে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা সংস্কৃতির পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ইউরোপীয়দের হাতে। ফলে মুসলিম সভ্যতা চালকের আসন হতে পেছনের আসনে চলে যায়। স্পেনে মুসলিম শাসনের বিপর্যয়ের পর মুসলিম সভ্যতা অতীত ইতিহাসে পরিণত হয়। এ সময়ে মুসলমানরা সামগ্রিকভাবে বিশ্বসভ্যতা এবং বিশ্বের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়নি। এমন কি, মধ্যযুগে যখন খ্রিষ্টান চার্চের তত্ত্বাবধানে ধর্মযাজকরা রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাতন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে, তখনও ইসলামী সভ্যতা মানবতাকে রক্ষা করার এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে সক্ষম হয়নি। যার ফলশ্রুতিতে যাজকতন্ত্রের প্রতিক্রিয়া হিসেবে সৃষ্টি হয় উদার নৈতিকতাবাদ। ক্রমে তা থেকে গড়ে উঠে সেক্যুলারিজম, ন্যাশনালিজম ইত্যাদি মতবাদ।

উদার নৈতিকতাবাদ এবং তার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা মূলত মানবিক মূল্যবোধের পরিপন্থি নীতিনৈতিকতাহীন বস্তুবাদী মতবাদ। এই মতবাদ পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার প্রবক্তা। এই অর্থব্যবস্থা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ফলপ্রসূ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে বলে ইতিহাস প্রমাণ করে না। বরং এটি মানুষকে স্বার্থপর যন্ত্রমানবে পরিণত করে। আর তা শোষণ, নিপীড়ন, স্বেচ্ছাচারিতা প্রভৃতির মাধ্যমে সামাজিক সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে। ফলে এর প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদী মতবাদ। এই ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকার কারণে রাষ্ট্রের বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী তাদের শ্রম, মেধা ও যোগ্যতার যথাযথ স্বীকৃতি লাভ হতে বঞ্চিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে অর্ধশতাব্দীকাল অতিক্রম করার আগেই এই মতবাদ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

সমাজতন্ত্রের পতনের পর ইসলামী আদর্শবাদ এই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসবে- এটাই ছিল সময়ের দাবি। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি, পাশ্চাত্যের তোষণনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানে পশ্চাদপদতা, অসম সামরিক শক্তি, মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের চিন্তাচেতনায় ধর্মনিরক্ষেতার প্রভাব প্রভৃতি কারণে মুসলিম বিশ্ব সমাজতন্ত্রের এই শূন্যস্থান পূরণে সক্ষম হয়নি। আর অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই স্থান পূরণে এগিয়ে আসে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। সুতরাং বর্তমান বিশ্বে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী ও অপ্রতিদ্ব›দ্ধী।

বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংকট হলো আত্মপরিচয়ের সংকট ও খিলাফতের জিম্মাদারী সম্পর্কে মুসলমানদের চরম উদাসীনতা। অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র পাশ্চাত্যের কলোনি থাকার কারণে অদ্যাবিধ মুসলিম মানসে পাশ্চাত্যের প্রভাব বিদ্যমান। আর এই প্রভাব হতে মুক্ত হওয়ার লক্ষ্যে শিক্ষাকাঠামো এবং বই পুস্তক প্রণয়নেও তারা সক্ষম হয়নি। ফলে উম্মাহর চেতনা বঞ্চিত মুসলিম বিশ্ব আজ শতধা বিভক্ত। এমতাবস্থায়, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত মুসলিম উম্মাহ গঠন সময়ের অপরিহার্য দাবি। এ ক্ষেত্রে আজকের সেমিনার পবিত্র হজের শিক্ষা ও দর্শনের আলোকে মুসলিম উম্মাহর সংকট উত্তরণে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদানে ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা মনে করি।

হজ মুসলিম উম্মাহর ওপর প্রবর্তিত সর্বশেষ ফরজ ইবাদত। মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র সুস্থিত মজবুত কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর হুদাইবিয়ার সন্ধির মাধ্যমে যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ হয়ে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে এবং অষ্টম হিজরী সালে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে ইসলাম একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী আদর্শ হিসাবে সুসংহত হওয়ার পর নবম হিজরী সালে হজ ফরজ হয়। কিন্তু তখনও পর্যন্ত বায়তুল্লাহর চত্ব¡র অমুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত না হওয়ার ফলে রাসূল (সা.) এ বছর পবিত্র হজ সম্পাদন করেননি বলে বাহ্যত প্রতীয়মান হয়। আবু বকর (রা.)-এর নেতৃত্বে এ বছর হজ পরিপালনকালে পরবর্তী বছর থেকে কাবার চত্বর অমুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। সুতরাং দশম হিজরী সালে মহানবী (সা.) তার উল্লেখযোগ্য সাহাবী নিয়ে সম্পূর্ণ ইসলামী পরিবশে পবিত্র হজ সম্পাদন করেন। এই হজে মুসলিম মিল্লাতের জন্য কোনো রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা এবং সামাজিক নিরাপত্তার কোনো সংকট ছিল না। বর্তমান নানাবিধ সংকটের আবর্তে নিপতিত মুসলিম উম্মাহ হজের শিক্ষা ও দর্শনের আলোকে কীভাবে তাদের সংকট উত্তরণ করতে পারে নিম্নে তা আলোকপাত করা হলো।

এক.

বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় সংকট হলো আত্মপিরিচয়ের সংকট। পবিত্র হজের চেতনা হল তৌহিদী চেতনা, যা আবহমানকাল ধরে তাদের নবী রাসূলগণের আদর্শিক চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে। মুসলিম মিল্লাতের আদি পিতা ইবরাহিম (আ.) আমাদের মুসলিম উম্মাহর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে ঘোষণা করেছেন। (সূরা হজ্জ : ৭৮) তা ছাড়া রাসূল (সা.) এবং তার পূর্ববর্তী নবীরা আরাফাতের ময়দানে যে দোয়া করেছিলেন, রাসূল (সা.) একে সর্বশ্রেষ্ঠ দোয়া হিসাবে ঘোষণা করেছেন। (জামে আত তিরমিযী) এতে প্রমাণিত হয় যে, রাসূল (সা.) এবং তার আগের নবী-রাসূলরা আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হয়েছিলেন। মুসলিম মিল্লাতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে বর্তমান মুসলিম উম্মাহ হজের বিধি-বিধান পালন করতে গিয়ে অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মৃতিচারণ করেন। ফলে তারা আত্মপরিচয়ের সন্ধান লাভ করে নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান হীনমন্যতা দূর করে সমৃদ্ধ অতীত ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ লাভ করেন।

দুই.

মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে হজ ফরজ হওয়ার জন্য সামর্থ্যরে বিষয়টিকে অবশ্যম্ভাবী বিবেচ্য বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। (আলে-ইমরান : ৯৭) মুফাসসিররা সামর্থ্য হিসাবে দৈহিক সক্ষমতা এবং আর্থিক সচ্ছলতাকে নির্দেশ করেছেন। আর্থিক স্বচ্ছলতাকে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সামষ্টিক পর্যায় পর্যন্ত প্রসারিত করার দীক্ষা হজের দর্শনে বিদ্যমান। বর্তমানে হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ব্যতীত অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নয়। অধিকন্তু অনেক দেশ দারিদ্র্যসীমার নীচে অবস্থান করছে। হজ আমাদের শিক্ষা দেয় দরিদ্র দেশগুলোর আর্থিক সংকট নিরসনে এগিয়ে আসা, মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ সাধনে আত্মনিয়োগ করা। এই লক্ষ্যে মুসলিম উম্মাহ পৃথক মুদ্রা তহবিল, কমন মার্কেট, অভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থা এবং সুদ বিবর্জিত অর্থব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে।

তিন.

বায়তুল্লাহ বিশ্বের প্রাচীনতম ঘর এবং ইবাদতের নিমিত্তে নির্মিত প্রথম ঘর। (আলে ইমরান : ৯৬) এটি পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থিত। যাকে মহান রাব্বুল আলামীন নিরাপদ নগরী হিসাবে ঘোষণা করেছেন। (আত-তীন : ৩) এখানে অবস্থিত কাবাগৃহে প্রবেশকারীদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি প্রদান করা হয়েছে। (আলে ইমরান : ৯৭) বর্তমান মুসলিম উম্মাহর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এমতাবস্থায়, হজের শিক্ষা ও দর্শনের আলোকে পবিত্র মক্কা নগরীর মতো প্রতিটি মুসলিম জনপদকে শান্তি ও নিরাপদ নগরীতে প্রতিষ্ঠা করা সময়ের অপরিহার্য দাবি।

চার.

মহান আল্লাহ, ফেরেশতা, আসমানী কিতাব এবং নবী রাসূলদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন ঈমানের অন্যতম অনুষঙ্গ। এর অনেকগুলো মানবগোচরের বাইরে হওয়ার কারণে একে ঈমান বিল-গায়ব বলা হয়। একজন হজযাত্রী আল্লাহর ঘর, এতদসন্নিহিত আয়াতে বাইয়্যিনাত তথা মাকামে ইবরাহিম, সাফা-মারওয়া, আরাফাত, মুযদালিফা, মিনা, কোরআন নাজিলের স্থানসহ অনেক ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন করে নিজের ঈমানকে ‘ঈমান বিশ শাহাদাত’ এর স্তরে উন্নীত করার সুযোগ লাভ করেন। এতে করে বিশ্বমুসলিমের ঈমানে শিরকসহ যেসব ঈমানবিধ্বংসী উপাদান যুক্ত হয়েছে, তারা তা বিদূরীত করার সুযোগ লাভ করে। আর একে আরও কার্যকর করে হজের স্লোগান- লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...,যাতেএকাধিকবার লা-শারীক-এর ঘোষণা বিদ্যমান।

পাঁচ.

হজ এমন একটি ইবাদত যা পালন করার জন্য বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তর থেকে আল্লাহপ্রেমী মানুষ একই সময়ে একই পোশাক পরিধান করে একই স্লোগান উচ্চারণ করে একই লক্ষ্যপানে ছুটতে থাকে। পরিবার-পরিজন, সহায়-সম্পদ সবকিছু পেছনে ফেলে আল্লাহপ্রেমী মানুষগুলো ঈমানী চেতনা এবং সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের অনুপম আদর্শ অনুসরণের মহড়া দেয়। ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চলের অর্গল ভেদ করে তারা উম্মাহর চেতনায় সমৃদ্ধ হয়, যাকে মহানবী (সা.) একটি দেহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। (সহিহ আল বোখারী : ৬০১১) এই ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে টেকসই কাঠামোতে রূপদান করতে পারলে শতধা বিভক্ত মুসলিম উম্মাহ একটি মহিরুহে পরিণত হতে পারে। (অসমাপ্ত)

লেখক : প্রফেসর, আরবী বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

মুসলিম উম্মাহ,সংকট উত্তরণ,হজের শিক্ষা
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত