ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মানবসভ্যতায় কোরবানির ঐতিহ্য

বনি ইসরাঈলের গাভী কোরবানি

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
বনি ইসরাঈলের গাভী কোরবানি

অতঃপর তারা গাভীটি নিজেদের কাছে সংরক্ষণ করল। এরইমধ্যে আল্লাহর কুদরতে বনি ইসরাঈল বংশে একটি ঘটনা ঘটে গেল। তাতে এই গাভীটি জবাই করার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যুবক তার গাভীটি স্বর্ণের দামে বিক্রি করল। এ ছিল মায়ের প্রতি ভক্তি ও খেদমতের কারণে আল্লাহ পাকের খাস দান।

ঘটনাটি ছিল, বনি ইসরাঈল বংশে একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে। তাতে আমীল নামক এক ব্যক্তি নিহত হয়। কিন্তু তার হত্যাকারী অজানা ছিল। আমীলের হত্যাকারী কে এবং তাকে হত্যা করার কারণ কী তা নিয়ে তাফসীরকারদের মধ্যে মতভেদ আছে।

আতা ও সুদ্দী বলেন, বনি ইসরাঈলে এক ব্যক্তি ছিল বিরাট ধনি। তার এক চাচাত ভাই ছিল খুবই গরিব। তার আর কোনো ওয়ারিশ ছিল না। আমীল তাড়াতাড়ি মরছে না দেখে, চাচাত ভাই তার উত্তরাধিকারী সম্পদ হস্তগত করার লোভে তাকে হত্যা করে।

কোনো কোনো তাফসীরকারের ভাষ্য হলো, আমীল তার এক চাচাত বোনকে বিয়ে করেছিল। মেয়েটি ছিল পরমা সুন্দরী এবং বনি ইসরাঈলের মাঝে তার রূপ ও গুণ উপমায় পরিণত হয়েছিল। ঐ মহিলাকে বিয়ে করার জন্য আমীলকে তার চাচাত ভাই হত্যা করে।

কালবী বলেন, আমীলের ভাতিজাই তাকে হত্য করে চাচাত বোন অর্থাৎ আমীলের মেয়েকে বিয়ে করার জন্য। তাকে হত্যা করার পর তার লাশ অন্য পাড়ায় নিয়ে যায় এবং গোপনে লাশটি সেখানে ফেলে আসে। বলা হয়েছে যে, দুটি গ্রামের মাঝখানে তার লাশ ফেলে আসা হয়।

হযরত ইবনে আব্বাসের আজাদকৃত দাস প্রখ্যাত মুফাসসির ইকরামা ইবনে আব্দুল্লাহ বলেন, বনি ইসরাঈলের একটি মসজিদ (উপাসনালয়) ছিল। মসজিদের বারটি দরজা বনি ইসরাঈলের বার গোত্রের জন্য বরাদ্দ ছিল। এক গোত্রের লোকেরা তাদের দরজার সামনে আমীল এর লাশ দেখতে পেল। তারা লাশটি টেনে অন্য দরজায় নিয়ে রাখল। এবার শয়তান এসে তাদের মাঝে ঝগড়া লাগিয়ে দিল।

ইবনে সীরীন বলেন, হত্যাকারী তাকে হত্যা করার পর তার লাশ নিয়ে আরেক লোকের দরজায় রেখে দিল। পরদিন হত্যাকারী নিজেই তার রক্তের বদলা নেওয়ার দাবিতে সোচ্চার হলো। বলল, যার দরজার সামনে লাশটি আছে সে আমীলকে হত্যা করেছে।

নিহত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন তখন হযরত মূসা আলাইহিস সালামের কাছে এল। তারা কিছু লোককে তার কাছে এনে অভিযোগ করল যে, এরাই আমীলকে হত্যা করেছে। তারা মূসা (আ.)-এর কাছে কিসাস বা হত্যার বদলে হত্যার দাবি উত্থাপন করল। মূসা আলাইহিস সালাম বিবাদী লোকদের কাছে জিজ্ঞাসা করলে তারা অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করল। তাতে মূসা (আ.)-এর কাছে বিষয়টি সংশয়পূর্ণ হয়ে গেল। ফলে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে তাদের মাঝে প্রচণ্ড মতবিরোধ দেখা দিল।

কালবী বলেন, এই ঘটনা ছিল তাওরাতে কাসসামা তথা কিসাস ও দিয়ত এর বিধান নাজিল হওয়ার আগেকার। তারা সবাই একজোট হয়ে মূসা (আ.) কে বলল, আপনি আল্লাহর কাছে হত্যাকারী কে তা আমাদের কাছে পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করার জন্য বলুন। মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহতায়ালার কাছে আরজি পেশ করলেন। আল্লাহ পাক তাদের একটি গাভী জবেহ করার হুকুম দিলেন। যারা বিবরণ এই আয়াতের মধ্যে বিধৃত।

‘স্মরণ কর যখন মূসা (আ.) তার কওমকে বলল, আল্লাহতায়ালা তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যেন তোমরা একটি গাভী জবেহ কর। (এ কথা শুনে) তারা বলল, আপনি কি আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা মশকরা করছেন। (আমরা বললাম নিহত ব্যক্তির হত্যাকারীর পরিচয় বলার কথা আর আপনি বলছেন গাভী জবেহ করার কথা। তাদের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথার জবাবে) মূসা (আ.) বললেন, আমি আল্লাহর কাছে পানাহ চাই যে, জাহিল লোকদের মত ঠাট্টা মশকরা করব।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-৬৭)।

লোকেরা বুঝতে পারল, গাভী জবাই করার হুকুম আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে। এরপরও তারা নানা প্যাঁচাল শুরু করল। ‘তারা বলল, আপনি স্বীয় পালনকর্তার কাছে আমাদের জন্য প্রার্থনা করুন তিনি যেন আমাদের গরুটির রূপ বিশ্লেষণ করে দেন। মূসা বললেন, সেটি হবে একটি গাভী, যা বৃদ্ধ নয়, বাছুরও নয়। (বড়ও নয়, ছোটও নয়।) উভয়ের (মাঝখানে, বার্ধক্য ও যৌবনের) মাঝামাঝি বয়সের। সুতরাং (এখন বেশি বাদানুবাদ না করে) যা আদেশ করা হয়েছে তা করে ফেল।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-৬৮) ।

‘তারা বলল, আপনার পালনকর্তার কাছে প্রার্থনা করুন, গরুটির রং কিরূপ হবে তা যেন তিনি বলে দেন। মূসা বললেন, এ সম্পর্কে আল্লাহ বলছেন যে, গাভীটি হবে গাঢ় পীতবর্ণের, দেখলে দর্শকরা আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়বে।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-৬৯)।

‘তারা বলতে লাগল, এবার আমাদের জন্য আরও একটি প্রার্থনা করুন, যাতে গাভীটির আর কি গুণাগুণ আছে, আরও স্পষ্ট করে বলে দেন। কারণ গরুর ব্যাপারে আমাদের মনে সাদৃশ্যের সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে। (এটা কি চাষাবাদ বা পানি সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে এমন হবে, নাকি নয়। ইনশাআল্লাহ আমরা অবশ্যই এবার ঠিক ঠিক বুঝে নেব।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-৭০)।

নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, তারা যদি ইনশাআল্লাহ না বলত তাহলে গাভীর রূপ ও আকৃতি বর্ণনা কোনো দিনও শেষ হত না এবং আরও জটিলতর হত।

‘মূসা (আ.) বললেন, আল্লাহতায়ালা বলছেন, গরুটি এমন হবে যে, তাকে হালচাষে জোড়া হয়নি; কিংবা শষ্যক্ষেতে সেচের কাজে খাটানো হয়নি। এক কথায় গরুটি হবে নিখুঁত নিদাগ, সম্পূর্ণ সুস্থ, দোষত্রুটিমুক্ত। তারা বলল, এবারই আপনি সঠিক ব্যাখ্যাটি দিয়েছেন। অতঃপর তারা গাভীটি জবেহ করল। অথচ তারা কাজটি করতে রাজি ছিল না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-৭১)।

মুহাম্মদ ইবনে কাব বলেন, উপরোক্ত পরিচয়ের গাভীর সন্ধানে তারা লেগে গেল। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেল না। শেষপর্যন্ত সেই মাতৃভক্ত যুবকটির কাছে গিয়ে দেখে তার গাভীটি বর্ণনার সঙ্গে সম্পূূর্ণ মিলে যায়। অতঃপর চামড়া ভর্তি স্বর্র্ণের দামে তা খরিদ করতে বাধ্য হয়।

কাসায়ী গাভীটি খরিদ করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলেন, তারা গাভীর খুঁজে মীশাইর কাছে এল। মীশাই তাদের বলল, এই গরু আমি বিক্রি করব না, যদি না আল্লাহর নবী মূসা (আ.) উপস্থিত থাকেন। তারা তাতে রাজি হলো। অতপর গাভীটি হযরত মূসা (আ.)-এর সামনে নিয়ে গেল। মূসা (আ.) গাভীর দাম জিজ্ঞাস করাতে মীশাই বলল, যদিও আপনার আর আমার মাঝে দরদাম বলা উচিত নয়; তবুও আমার কথা হলো, এই গাভীর চামড়াভর্তি স্বর্ণ না হলে আমি গাভী বিক্রি করব না। মূসা (আ.) তখন বনি ইসরাঈলের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা (্প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে বিষয়টি নিজেদের জন্য জটিল করে ফেলেছ। ফলে আল্লাহতায়ালা ব্যাপারটিকে তোমাদের জন্য জটিল ও কঠিন করে দিয়েছেন। অগত্যা বাধ্য হয়ে তারা তাই করল। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহতায়ালা বলেন,

‘স্মরণ কর, যখন তোমরা একজনকে হত্যা করে, পরে সে সম্পর্কে একে অপরকে দোষারোপ করছিলে, যা তোমরা গোপন করছিলে তা প্রকাশ করে দেওয়াই ছিল আল্লাহতায়ালার অভিপ্রায়।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-৭২)।

‘অতঃপর আমি নির্দেশ দিলাম গরুটি জবাই করার পর এর একটি টুকরা দ্বারা মৃতকে আঘাত কর। এইভাবে আল্লাহ মৃতকে জীবিত করেন এবং তোমাদের তার নিদর্শনগুলো প্রদর্শন করেন, যাতে তোমরা চিন্তাভাবনা করতে পার।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-৭৩)।

গাভীর শরীরের কোন অংশ নিয়ে আঘাত করা হয়, তা নিয়ে তাফসীরকারদের মতামত ভিন্ন ভিন্ন। হযরত ইবনে আব্বাস বলেন, গাভীর ঘাড়ের তরুণাস্থির সঙ্গে যুক্ত হাড় দিয়ে আঘাত করা হয়। যাহহাক বলেন, গাভীর জিহ্বা দিয়ে আঘাত করা হয়। হুসাইন ইবনে ফযলও বলেন, সর্বোত্তম মত হলো জিহ্বা। কেননা, মূল উদ্দেশ্য নিহত ব্যক্তি কথা বলা। কথা বলার অঙ্গই হচ্ছে জিহ্বা।

সাঈদ জুবাইর বলেন, লেজের গোড়া দিয়ে নিহতের দেহে আঘাত করা হয়। ইয়ামান ইবনে যারয়াবও বলেন, এই মতটিই সঠিক। কেননা, লেজের গোড়ার অস্থিগুলোই সর্বপ্রথম সৃষ্টি করা হয়। আর এটিই শরীরের সর্বশেষ অংশ, যা পঁচে যায়। মুজাহিদ বলেন, গাভীর লেজ নিয়ে নিহতের শরীরে আঘাত করা হয়। ইকরামা ও কলবীর মত হল, গাভীর রান নিয়ে। সুদ্দীর মত হল দুই কাঁধের মধ্যস্থিত গোশতের টুকরা নিয়ে আঘাত করা হয়। আরও একটি মত হচ্ছে অঙ্গটি ছিল কান।’ (নাহায়াতুল আরব, শাহাব উদ্দীন নুবাইরী।)

যাইহোক আঘাত করার পর নিহত ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমে উঠে দাঁড়ায়। তখনও তার গর্দানের রগ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। এ অবস্থায় তিনি বলেন, অমুক ব্যক্তি আমাকে হত্যা করেছে। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আবার ওই স্থানে ঢলে পড়েন। আল্লাহতায়ালা চাক্ষুষ দেখিয়ে দেন যে, এভাবেই তিনি কেয়ামতের দিন মৃতদের পুনরায় জীবিত করবেন।

কালবী বলেন, এতবড় স্পষ্ট নিদর্শনের পরও, নিহত ব্যক্তি এত পরিষ্কার ভাষায় সাক্ষ্য দেওয়ার পরও তারা বলল যে, আমরা আমীলকে হত্যা করিনি। আসলে তাদের চাইতে কঠোর নিষ্ঠুর মনের মানুষ আর কেউ ছিল না। যে কারণে তারা তাদের পয়গাম্বরকেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। আল্লাহ পাক তাদের এ অবস্থা সম্পর্কে বলেন, ‘এরপরও তোমাদের হুদয় কঠিন হয়ে গেল। এটি পাষাণ কিংবা তদপেক্ষা কঠিন। পাথরও কতক এমন যে, তা থেকে নদীনালা প্রবাহিত হয় এবং কতক এমন যে, বিদীর্ণ হওয়ার পর তা থেকে পানি নির্গত হয়। আবার কতক এমন, যা আল্লাহর ভয়ে ধসে পড়ে এবং তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্মন্ধে অনবহিত নয়।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-৭৪)। হত্যাকাণ্ডের তথ্য উদ্ঘাটনে গরু কোরবানির এই ঘটনাও প্রমাণ করে আল্লাহ পাকের সান্নিধ্য লাভ এবং তার কাছ থেকে ফায়সালা জানার অন্যতম মাধ্যম কোরবানি। যুগে যুগে কোরবানির এই ঐতিহ্যকে ধারণ করে আছে মুসলিম জাতি। আমরা এখন মানব ইতিহাসের আরেকটি কোরবানির ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করব। এর মধ্যেও আমরা ইসলামের সৌন্দর্য, মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ অনুধাবন করতে সক্ষম হব।

বনি ইসরাঈল,গাভী কোরবানি,কোরবানির ঐতিহ্য,মানবসভ্যতা
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত