ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মদিনার মসজিদে নববিতে জুমার খুতবা

হজ পালনে মোমিনের প্রস্তুতি

শায়খ ড. আবদুল্লাহ বিন আবদুর রহমান আল-বুআইজান
হজ পালনে মোমিনের প্রস্তুতি

আল্লাহর আনুগত্য সবচেয়ে উত্তম উপার্জন, তার সন্তুষ্টি সবচেয়ে বড় অর্জন। জান্নাত কঠিন ও কষ্টকর কাজ দিয়ে ঘেরা, জাহান্নাম প্রবৃত্তির সুখ ও আনন্দদায়ক বিষয় দিয়ে পরিবেষ্টন করা। আল্লাহ বলেন, ‘কেয়ামতের দিন তোমাদেরকে তোমাদের কর্মফল পূর্ণ মাত্রায় দেওয়া হবে। যাকে আগুন থেকে দূরে রাখা হবে ও জান্নাতে প্রবেশ করা হবে সেই সফলকাম। আর পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ছাড়া কিছুই নয়।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৮৫)। তাই, আল্লাহকে ভয় করুন। যেসব নির্দেশ তিনি দিয়েছেন, সেগুলো মেনে চলুন। যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন, সেগুলো থেকে দূরে থাকুন।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মোমিনরা, তোমরা আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় করো ও মুসলমান না হয়ে কোনো অবস্থায় মৃত্যুবরণ করো না।’ (সুরা আলে ইমরান : ১০২)। লোকসকল, আপনারা সম্মানিত মাসে আছেন, পবিত্র ভূমিতে অবস্থান করছেন, আর সামনে রয়েছে ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হজ- আল্লাহর ঘর বরাবর আদায়ের সুবর্ণ সুযোগ। এই মহান ইবাদতের প্রস্তুতির অন্যতম দিক হলো এর সঙ্গে সম্পর্কিত বিধানগুলো শেখা। তাই, হাজীর জন্য জরুরি হলো, তিনি কীভাবে হজ করবেন- তা ভালোভাবে শেখে নেওয়া। কী কী বিষয় হজের রুকন, কী কী বিষয় ওয়াজিব ও কোন কাজগুলো নিষিদ্ধ- এই বিষয়গুলো ভালোভাবে জানা। কারণ, আমলের আগে জানার অবস্থান। আল্লাহকে খুশি করতে হলে নিজের মন মতো না; বরং জানা ও স্পষ্ট উপলব্ধির ভিত্তিতে ইবাদত করতে হয়।

ইলম বা জ্ঞানার্জন করা মানেই আল্লাহভীতি অর্জন করা। ইলম অর্জন করা ইবাদত, জ্ঞান অন্বেষণ করা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদতুল্য, যে জানে না তাকে শেখানো সদকাস্বরূপ, আর উপযুক্তদের মাঝে জ্ঞান বিতরণ করা আল্লাহর কাছে নৈকট্য লাভের মাধ্যম।

আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো, এমন ইলম অর্জন করা যার মাধ্যমে বান্দা সঠিকভাবে ইবাদত করতে পারে। আজকের যুগে আল্লাহ অসংখ্য সুযোগ-সুবিধা সহজ করে দিয়েছেন। হাতে হাতে রয়েছে প্রযুক্তি, সঠিক পরিবেশ- তাই এখন কারও অজ্ঞানতার কোনো অজুহাত নেই। প্রত্যেকের জন্য জ্ঞানার্জনের পথ উন্মুক্ত।

হজ করতে আগ্রহী হে মহান ব্যক্তি, হজের বিধান শেখা শুধু প্রস্তুতি নয়; বরং এটা হজেরই অংশ। বরং বলা যায়, সঠিকভাবে হজ আদায়ের শর্ত হলো এই বিধানগুলো ঠিকভাবে শেখা। তাই, বিশ্বস্ত ও গ্রহণযোগ্য আলেমদের কাছে এবং অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে হজের নিয়মণ্ডকানুন শেখার জন্য সচেষ্ট হোন, যেন আপনারা শরিয়ত অনুযায়ী হজের সব কাজ ঠিকভাবে করতে পারেন।

আল্লাহ আজকের যুগে আমাদের জন্য এমন সব শিক্ষার মাধ্যম সহজ করে দিয়েছেন- যা পূর্ববর্তী যুগের লোকদের জন্য সহজ ছিল না। অনেক ভাষায় ভিডিও গাইডলাইন, প্ল্যাটফর্ম, নির্দেশিকা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাবিষয়ক দিকনির্দেশনা- সবই এখন সহজলভ্য।

তাহলে এখনও কি কারও অজুহাত রয়েছে, ‘আমি জানতাম না’? এখনও কি কারও জন্য অজ্ঞ থাকা গ্রহণযোগ্য? আমাদের সময়কে কাজে লাগাতে হবে, হজের নিয়ম শিখতে হবে, আর আল্লাহর মেহমান হজযাত্রীদের সেবা করার প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ, মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববির ধর্মীয় দফতর, সাধারণ তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃপক্ষ এবং হজ ও ওমরা মন্ত্রণালয়- তাদের দাওয়াতি প্লাটফর্মের মাধ্যমে সবরকম তথ্য ও সহযোগিতা দিচ্ছে, যার ভিত্তি কোরআন ও সহিহ হাদিস, আর তাতে রয়েছে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, নিয়মণ্ডকানুন, সহায়ক নির্দেশনা- সবকিছু। তাই এই সুযোগকে গ্রহণ করুন, এর ওপর নির্ভর করুন। আল্লাহ যেন আপনাদের হজ কবুল করেন।

আল্লাহর মেহমানবৃন্দ, পবিত্র কাবাঘরের হাজীরা ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মসজিদের সফরকারী, আল্লাহ আপনাদের প্রতি দয়া করে আপনাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন যে, আপনাদের এই পবিত্র নগরী মদিনা মুনাওয়ারায় আসার সৌভাগ্য দান করেছেন। এ শহর শুদ্ধতম শহর, ঈমানের ঘাঁটি, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের জায়গা, তাঁর আশ্রয়স্থল, বসবাসের স্থান ও প্রশান্তির জায়গা। এই শহর মক্কার পর পৃথিবীর মধ্যে আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় ও মর্যাদাপূর্ণ স্থান। তাই এর মর্যাদা বুঝুন, এর গুরুত্ব ও ফজিলত উপলব্ধি করুন, এর সম্মান বজায় রাখুন, এর পবিত্রতা অনুভব করুন এবং এখানে উত্তম শিষ্টাচার ও সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে চলাফেরা করুন। এই শহরের পবিত্রতা লঙ্ঘন করবেন না, এতে কোনো নতুন বেদয়াত বা গোমরাহি চালু করবেন না।

আল্লাহতায়ালা আপনাদের রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মসজিদ পরিদর্শনের সৌভাগ্য দিয়েছেন- এই মসজিদ প্রথম দিন থেকেই তাকওয়ার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত মসজিদগুলোর একটি। এই মসজিদে ইবাদত করা অন্য সব মসজিদের চেয়ে বহু গুণে বেশি সওয়াবের কাজ, শুধু মসজিদুল হারাম ছাড়া। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমার এ মসজিদে নববিতে এক রাকাত নামাজ মসজিদুল হারাম ছাড়া অন্য কোনো মসজিদে এক হাজার রাকাত নামাজের চেয়েও উত্তম।’ (মুসলিম : ৩২৬৫)।

হে জিয়ারতকারী, এই স্থানটি ইবাদতের জন্য নির্ধারিত। তাই এখানে শরিয়তবিরোধী বেদয়াত, গোমরাহি, ফিতনা বা গর্হিত কোনো কাজ করবেন না। এমন কিছু করবেন না যাতে মানুষের মন খারাপ হয় বা তারা ইবাদত থেকে মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। এখানে অবস্থান করার সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগান। মনোযোগ ও ঈমানসহকারে আল্লাহর দিকে ফিরে আসুন। এখানে ইবাদতের মর্যাদা অনেক বেশি। অলসতা, খেলাধুলা, মোবাইলে ব্যস্ত থাকা, বাজে কথাবার্তা ও নিরর্থক কাজে সময় নষ্ট করবেন না। সর্বাবস্থায় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে চলুন, যারা এই পবিত্র জায়গায় সেবা ও শৃঙ্খলার কাজ করছেন তাদের নির্দেশনা মানুন এবং ভালো কাজে সহায়তা করুন; খারাপ কাজে নয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পর সহযোগিতা করবে এবং পাপ ও সীমালংঘনে একে অন্যের সহযোগিতা করবে না।’ (সুরা মায়েদা : ২)।

সম্মানিত জিয়ারতকারীরা, ইবাদত শুধু শরীরচর্চা বা কায়িক পরিশ্রম নয়; বরং ইবাদতের আসল অর্থ হলো, আল্লাহর আদেশ পালন করা, তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে দূরে থাকা, দয়া ও ভালোবাসা নিয়ে তাঁর সামনে বিনয়ী হওয়া, তাঁর কাছে কিছু পাওয়ার আশা করা ও তাঁর শাস্তির ভয় রাখা। একজন বান্দার ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হলে দুটি শর্ত পূরণ করতে হয়। প্রথম শর্ত, ইখলাস বা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদত করা- রিয়া বা লোক দেখানোর জন্য নয়। দ্বিতীয় শর্ত, ইবাদত হতে হবে আল্লাহর কিতাব ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী। ইবাদত এমন হতে হবে যার ভিত্তি হয় কোরআন-সুন্নাহ থেকে শোনা, মানা ও অনুসরণ করার ওপর; নিজের ইচ্ছা বা কোনো নতুন উদ্ভাবনের ওপর নয়।

আপনারা ইখলাসের সঙ্গে ইবাদত করুন ও রাসুলের সুন্নাহ অনুযায়ী তা পালন করুন। জাবের (রা.) বলেন, ‘আমি কোরবানির দিন মহানবী (সা.)-কে বাহনে আরোহিত অবস্থায় পাথর নিক্ষেপ করতে দেখেছি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কাছ থেকে তোমরা হজের নিয়মণ্ডকানুন শিখে নাও। কারণ আমি জানি না, এ হজের পর আমি আর হজ করতে পারব কি না।’ (মুসলিম : ৩০২৮)।

সম্মানিত হাজীরা, আল্লাহ আপনাদের প্রতি দয়া করেছেন যে, আপনারা হজ পালনের নিয়ত করেছেন, সময়, শ্রম, অর্থ- সবকিছু উৎসর্গ করেছেন। তাই অভিনন্দন আপনাদের, যেহেতু নিয়ত করেছেন, তাই যদি ইখলাস সহকারে করেন, তাহলে তাতে আপনাদের বরকত হবে। আপনারা হজকে ঠিকঠাকভাবে পালন করুন, সম্পূর্ণ করুন ও আল্লাহর কাছে কবুল হওয়ার জন্য চেষ্টা করুন। হজের বিধি-বিধান শিখে নিন ও খেয়াল রাখুন যেন অশ্লীল কথা, গোনাহর কাজ ও ঝগড়া না হয়। আল্লাহ বলেন, ‘হজ হয় সুনির্দিষ্ট মাসসমূহে। এরপর যে কেউ এ মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে তার জন্য হজের সময়ে স্ত্রী-সম্ভোগ, অন্যায়-আচরণ ও কলহ-বিবাদ বিধেয় নয়।’ (সুরা বাকারা : ১৯৭)। এজন্য আপনাদের উচিত ধৈর্যশীল ও শান্ত থাকা, ভিড়ের সময় একে অপরের প্রতি দয়াশীল হওয়া, ধাক্কাধাক্কি না করা ও দুর্বলদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। জাবের (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) উসামা ইবনে জায়েদ (রা.)-কে নিজের পেছনে বসিয়ে আরাফা থেকে রওনা হন। তিনি তাঁর উটের লাগাম টান টান করছিলেন- এতটাই নত হয়েছিল যে, উটের মাথা ছিল তার কাঁধের কাছে। তিনি ডান হাত তুলে বলছিলেন, হে মানুষ! শান্ত থাকো, শান্ত থাকো।’ (মুসলিম : ২৮৪০)।

(২৫-১১-১৪৪৬ হিজরি মোতাবেক ২৩-০৫-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন আবদুল কাইয়ুম শেখ)

হজ পালন,হজের প্রস্তুতি
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত