নবুয়াতের দ্বাদশ বছর। হজের মৌসুম চলছে। নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী হজ করতে মক্কায় এসেছেন মানুষ। কাবাঘর কাফেরদের করতলে। মুসাইব ইবনে উমায়ের (রা.) মদিনা থেকে মুসলিমদের একটি বড় কাফেলা নিয়ে মক্কায় এসেছেন। ১২ জিলহজ, রাতের তৃতীয় ভাগ। কাফেলার সবাই তাঁবুর ভেতর ঘুমোচ্ছে। একদল নবিপ্রেমে ব্যাকুল হৃদয় জেগে আছেন। সুযোগ খুঁজছেন প্রিয়র কাছে যাওয়ার। সুযোগ মতো তারা পথ চলছেন আকাবা অভিমুখে। দেখা হবে প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে। এই প্রথম দেখবেন ভালোবাসার মানুষটাকে। তাদের মনে বিপুল উত্তেজনা। নিজের মতো করে কত ছবিই তো এঁকেছেন নবীজিকে ঘিরে। আকাবায় নবীজির সঙ্গে দেখা হলো তাদের। তারা সংখ্যায় ৭৫ জন। ৭৩ জন পুরুষ এবং দুজন নারী। আহ্! কী অনুভূতি! চোখ ফেরানো যায় না। পূর্ণিমার আলোয় মানুষটা আরও আলোকিত হয়ে ধরা দিচ্ছেন তাদের চোখে। এমন মানুষ তারা জীবনেও দেখেননি। নবীজির সঙ্গে আছেন তাঁর পিতৃতুল্য চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (রা.)- তিনি তখনও মুসলিম হননি।
তারা বাইয়াত হন নবীজির কাছে। তারা তাঁকে মদিনায় দাওয়াত করেন। তাঁর জীবনের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁর জীবনের নিরাপত্তায় জীবনবাজি রেখে শপথ নেন ছোট্ট দুটি হাতও। কোমল হৃদয়ের কোমল হাত। এতটুকুন বয়সে আত্মায় ধারণ করে নিয়েছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রসূনকে। তিনি সাহসী পিতা-মাতার সাহসী সন্তান হাবিব ইবনে জায়েদ আল-আনসারি। আকাবায় শপথ নিয়েছেন তার পিতা জায়েদ ইবনে আসেম, ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে জায়েদ এবং মাতা নাসিবা আল-মাজেনিয়া। যিনি ‘উম্মে উমারা’ নামে পরিচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) হাবিবের পরিবারের প্রতি খুশি হয়ে দোয়া ও প্রশংসা করেছেন- ‘আল্লাহ তোমাদের বরকত দান করুন। আল্লাহ তোমাদের ওপর রহম করুন। আহলে বাইয়াতের পক্ষ থেকে তোমাদেন জন্য রইল এই কৃতজ্ঞতা ও প্রার্থনা।’
বদর যুদ্ধের সময় হাবিব (রা.) কিশোর। যুদ্ধে যেতে পারেননি। যখন ওহুদের ডঙ্কা বাজল, তখনও বারণ পড়ল তার নামে। কারণ তিনি এখনও অস্ত্রধারণের যোগ্য হয়ে ওঠেননি। তবে পরে সবগুলো যুদ্ধেই তিনি বীরদর্পে লড়েছেন। ইসলামের পতাকা সমুন্নত রেখেছেন। রাসুলের প্রতি নিরেট ভালোবাসা ও আনুগত্যের যে ইতিহাস তিনি রচনা করেছেন- রাসুলপ্রেমিদের জন্য সেটা শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
হাবিব (রা.)-এর পরিবারের সদস্যরা আমৃত্যু ইসলামের জন্য যুদ্ধ করেছেন। ওহুদ যুদ্ধে তার মা উম্মে উমামা অংশ নিয়েছিলেন সেবিকা হিসেবে। পরে প্রয়োজনে হয়ে উঠেন যোদ্ধা। পেয়ে যান রাসুলের দোয়া। তার ভাই আব্দুল্লাহও ওহুদ যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর পরিবারের জন্য দোয়া করেন- ‘হে আল্লাহ, জান্নাতে ওদের আমার সঙ্গী বানিয়ে দাও।’
উম্মে উমারা ইয়ামামার যুদ্ধেও বীরত্বের সঙ্গে লড়েছেন। আল্লাহর নবীর শত্রু ও পুত্র হাবিবের হত্যাকারীকে শেষ করার সংকল্প নিয়েই লড়েছেন সে যুদ্ধে।
নবম হিজরি। ইসলামের পতাকার ছায়ায় পৃথিবীর মানুষ জড়ো হচ্ছে। আরবের ভূখণ্ড পেরিয়ে দূর-দূরান্তে ইসলামের আলোর মশাল জ্বলছে। আরবের নজদ প্রদেশের একদল লোক রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করতে এসেছে। তাদের সঙ্গে আছে মুসলায়মা ইবনে হাবিব। ইতিহাস যাকে ‘মুসায়লামাতুল কাজ্জাব’ (মিথ্যা নবী দাবিদার) নামে চেনে। মুসায়লামাকে সামানার প্রহরায় রেখে প্রতিনিধি দল নবীজির সঙ্গে দেখা করেন। ফিরে এসে তারা নবীজির পক্ষ থেকে মুসায়লামাকেও বাইয়াত নেন। নজদ প্রদেশে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে সে মুরতাদ হয়ে যায় । নিজেকে নবী দাবি করে। গোত্রের প্রায় লোকেরা বংশ ও গোত্রপ্রীতির অজুহাতে তার কথা মেনে নেয়। মুসায়লামার অনুসারী বাড়তে থাকে। তার গোত্রের প্রায় সবাই প্রতিনিধিত্ব করছে। সে মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে পত্র পাঠায়- ‘আল্লাহর রাসুল মুসায়লামার পক্ষ থেকে আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদের প্রতি। আসসালামু আলাইকুম, আমাকেও আপনার মতো নবুয়াত পালনের আদেশ করা হয়েছে। আরব ভূখণ্ডের অর্ধেক আমার আর অর্ধেক আপনার। তবে কুরাইশ একটি সীমালঙ্ঘনকারী জাতি।’ নবীজি মুসায়লামাকে পাল্টা চিঠি লেখেন। নবীর চিঠির ভাষা এরকম- ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম, আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে ভণ্ড মিথ্যুক মুসায়লামার প্রতি। ইসলাম ও হেদায়াতের অনুসারীর প্রতি সালাম। সন্দেহ নেই, সমগ্র ভূখণ্ডের অধিপতি একমাত্র আল্লাহ। তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকেই তাঁর ইচ্ছা এর আধিপত্য দান করেন। আর চূড়ান্ত শুভ পরিণতি শুধু তাদের জন্য যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর হুকুম মেনে চলে।’
নবীজির এই চিঠি মুসায়লমার কাছে বহন করে নিয়ে আসেন ইসলামের জন্য নিবেদিত পরিবারের সন্তান হাবিব ইবনে জায়েদ। চিঠির বক্তব্য পড়ে মুসায়লামা ক্ষেপে উঠে। সে হাবিবকে বন্দি করে। পর দিন দুপুরে তার সভাসদে তাকে উপস্থিত করার নির্দেশ দেয়। সভাসদ বসল। তার আশপাশে কয়েকজন প্রধান অনুসারী। শিকল পরানো অবস্থায় নবীপ্রেমিক হাবিব (রা.)-কে হাজীর করা হলো। তিনি মাথা উঁচু করে বুকটান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভয়ের কোনো লেশ নেই তার চেহারায়, দেহে এবং সমস্ত সত্তায়। মুসায়লামা তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কি মুহাম্মাদকে আল্লাহর রাসুল বলে সাক্ষ্য দাও?’
‘অবশ্যই, আমি সাক্ষ্য দিই, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল।’
‘তুমি কি এটা স্বীকার করো, আমি আল্লাহর রাসুল?’
তিনি পরিহাস করে বলেন, ‘আমার কানে সমস্যা আছে, তোর কথা শুনতে পাচ্ছি না।’ হাবিবের কথা শুনে মুসায়লামা ক্ষেপে যায়। চেহারার রং পাল্টে যায়। রক্তের নেশায় উন্মাদ হয়ে উঠে। জল্লাদকে হুকুম করে, ‘ওর ডান হাত কেটে ফেলে।’ পাষ- জল্লাদ এক কোপে তার ডান হাত কেটে দেয়। আকাবার রাতে রাসুলের হাতে শপথ নেওয়া সেই হাত মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে থাকে। মুসায়লামা একই প্রশ্নের পুনারাবৃত্তি করে।
ঈমানি শক্তিতে বলীয়ান হাবিব বুক চিতিয়ে বলেন, ‘অবশ্যই, আমি সাক্ষ্য দিই, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল।’
‘তুমি কি এটা স্বীকার করো, আমি আল্লাহর রাসুল? আবারও সেই পরিহাসের কণ্ঠে বলেন, ‘আমি তো আগেই বলেছি, তোর এমন নোংরা কথা আমার কান শুনতে পায় না। তুই শুনে রাখ, মুহাম্মাদ (সা.) আমার প্রিয় নবী। তাঁর জন্য আমার জীবন উৎসর্গিত। আমার জন্মই হয়েছে মুহাম্মাদের জন্য। আমি সেই ছেলেবেলায় মা-বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে আকাবার রাতে তাঁর পবিত্র হাতে হাত রেখে শপথ করেছি, ফিদাকা আবি ওয়া উম্মি ওয়া নাফসি ইয়া রাসুলুল্লাহ।’
মুসায়লামার হুকুমে জল্লাদ তার বাম হাত কেটে ফেলে। কাটা হাত মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। এভাবে তার নৃশংস, নিষ্ঠুর, অমানবিক অত্যাচার চলতে থাকে। একটার পর একটা অঙ্গ কাটতে থাকে। সভার লোকেরা নিশ্চুপ। বিহ্বল। হাবিব একটুও ‘আহ্!, উহ’ শব্দ করেননি। টলে যাননি। বুকটান করে রাখলেন। মনে তাঁর মুহাম্মাদের প্রেম। চোখে জান্নাতের ছবি। প্রতিবার জবাবে বলছেন, ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।’
রাসুলের প্রেমে উৎসর্গিত প্রতিটি অঙ্গ মাটিতে পড়ে থাকে। দেহের অংশটি পড়ে থাকে একপাশে। আকাবার রাতে শপথ পাঠ করা বিশ্বাসী মুখে পবিত্র ধ্বনি উচ্চারিত হতে থাকে ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।’
হাবিব ইবনে জায়েদ (রা.)-এর এই নির্মম হত্যার সংবাদ মদিনায় ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ শোকে কাতর হয়। হাবিবের মা উম্মে উমারা একটুও বিচলিত হননি। দুঃখ প্রকাশ করেননি। আল্লাহর শোকর আদায় করলেন। ধৈর্য ধরলেন। আল্লাহর কাছে এর প্রতিদান চাইলেন। তিনি তো সন্তানকে এজন্যই মানুষ করেছিলেন। তিনিই তো ওহুদ যুদ্ধে তার যোদ্ধাহত সন্তান আব্দুল্লাহকে বলেছিলেন- ‘বেটা, আল্লাহর জন্য ওঠো, আল্লাহর দুশমনদের খতম করতে এগিয়ে যাও, ওঠো বাবা, ওঠো...।’
এর মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.) মারা গেলেন। আবু বকর সিদ্দিক (রা.) খলিফা। এদিকে নতুন নতুন ফেতনা দেখা দিতে লাগল। আবু বকর (রা.) ভণ্ডনবী দাবিদার মুসায়লামার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেন। তখন ৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দ। খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-এর নেতৃত্বে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে অন্যান্যদের সঙ্গে হাবিবের মা উম্মে উমারা, তার বড় ভাই আব্দুল্লাহও চললেন। আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধের পাশপাশি সন্তানের হত্যাকারী মুসায়লামাকে মেরে প্রতিশোধ নিতে চান তিনি। ইয়ামামার প্রান্তরে যুদ্ধ বাঁধল। দুই পক্ষে প্রচণ্ড লড়াই চলল। উম্মে উমারা বীরদর্পে যুদ্ধ করছেন। শত্রুদের ব্যুহ ভেদ করে সম্মুখে চলছেন। লক্ষ্য নবীর দুশমন ও সন্তানের হত্যাকারী মুসায়লামাতুল কাজ্জাবকে জাহান্নামে পাঠানো। সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন আর চিৎকার করছেন- ‘কোথায় আল্লাহর দুশমন, আমাকে দেখিয়ে দাও।’
উম্মে উমারাকে একজন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, মৃত মুসায়লামাতুল কাজ্জাবকে। এর মধ্যে অহশি ইবনে হরব তাকে হত্যা করে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিয়েছে।