ঢাকা মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কোরবানি ও সহমর্মিতা

মুহাম্মদ সরকার
কোরবানি ও সহমর্মিতা

জীবনের সত্য উপলব্ধি আসে ত্যাগে। ভালোবাসার জিনিস আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিলিয়ে দিলে মানুষের আত্মা আলোকিত হয়। সেই চিরন্তন ত্যাগের পাঠ আমাদের দেয় কোরবানি। ইসলামি ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এটি। কোরবানি শুধু একটি পশু জবাইয়ের নাম নয়, এটি একজন মানুষের, একটি জাতির, একটি সভ্যতার আত্মত্যাগ, মানবিকতা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার চরম বহিঃপ্রকাশ।

ইবরাহিমি আত্মত্যাগ কোরবানির ভিত্তি : কোরবানি প্রসঙ্গে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ইবরাহিম (আ.) ও তার ছেলে ইসমাইল (আ.)-এর আত্মত্যাগ। এক রাতে স্বপ্নে ইবরাহিম (আ.) দেখেন, তিনি তার ছেলেকে জবাই করছেন। স্বপ্নটি কয়েকবার দেখার পর তিনি নিশ্চিত হন, এটি একটি ঐশী আদেশ। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি তাকে সহনশীল একটি ছেলের সুসংবাদ দিলাম। তারপর যখন সে তার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছাল, তখন বলল, হে ছেলে! আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমি তোমাকে জবাই করছি। বল তো, তোমার অভিমত কী? সে বলল, বাবা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন, তা-ই করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’ (সুরা সাফফাত : ১০১-১০২)। এ দৃশ্য একদিকে যেমন বাবার আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের নিদর্শন, তেমনি অন্যদিকে ছেলের আনুগত্য ও তাকওয়ার পরাকাষ্ঠা।

তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধির শিক্ষা : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর কাছে তাদের গোশত ও রক্ত পৌঁছে না; বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ : ৩৭)। এ আয়াত আমাদের কোরবানির অন্তর্নিহিত দর্শনের দিকে নিয়ে যায়। এটা কেবল পশু জবাই নয়, বরং নিজের অহংকার, লোভ, হিংসা, বিদ্বেষ, অপবিত্র বাসনার কোরবানি। যে কোরবানি কেবল বাহ্যিক, তা আল্লাহর দরবারে কবুল নয়। প্রকৃত কোরবানি হলো অন্তরের তাকওয়ার বহিঃপ্রকাশ।

গোশত বণ্টনে সমাজতাত্ত্বিক সৌন্দর্য : ইসলাম কোরবানির গোশত তিনভাগে ভাগ করার কথা বলে। একভাগ নিজের জন্য, একভাগ আত্মীয়-পরিজনের জন্য এবং একভাগ দরিদ্র-নিরুপায় মানুষের জন্য। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তোমরা কোরবানির গোশত খাও, সংরক্ষণ কর এবং দান কর।’ (মুসলিম : ১৯৭১)। রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার সাহাবিদের বলেন, ‘তোমরা তিনদিনের বেশি গোশত জমিয়ে রেখ না, গরিবদের দাও।’ (বোখারি : ৫৫৭৩)। যদিও পরে এ সময়সীমা তুলে নেওয়া হয়, তবে এর মধ্য দিয়ে ইসলাম গরিবের প্রতি কতটা সংবেদনশীল, তা বোঝা যায়।

কোরবানির প্রকৃত সমাজবোধ : আজকের সমাজে কোরবানির পশু অনেক সময় প্রতিযোগিতার বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। বড় গরু, দামি খাসি, একাধিক উট- এসব যেন আত্মতৃপ্তি ও লোকদেখানোর মাধ্যম। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে লোক রিয়া করে, সে শিরক করে।’ (মুসনাদে আহমদ : ২০০০৩)। ইবনে আবিদ্দুনিয়া (রহ.) বলেন, ‘কোরবানির প্রকৃত চেহারা হলো গোপনে দেওয়া, কাউকে হেয় না করা এবং অন্তরে আল্লাহভীতি থাকা।’

সমসাময়িক বাস্তবতায় কোরবানি : বাংলাদেশে কোরবানির সময় একদিকে আনন্দ আর অন্যদিকে কিছু জায়গায় দেখা যায়, গরিব মানুষদের লাইন ধরিয়ে, ছবি তুলে গোশত বিতরণ করা হয়। এটি সহমর্মিতা নয়, বরং দয়ার মোড়কে লাঞ্ছনা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ প্রকৃত মুসলমান নয়, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই কামনা করে, যা সে নিজের জন্য কামনা করে।’ (বোখারি : ১৩)। এ শিক্ষার আলোকে আমাদের কোরবানি হতে হবে সম্মানজনক এবং আত্মমর্যাদাশীল।

কোরবানি ও ইসলামি অর্থনীতি : কোরবানির মাধ্যমে ইসলাম দরিদ্রের মাঝে সম্পদ বণ্টনের যে পদ্ধতি চালু করে, তা আজকের পুঁজিবাদী অর্থনীতির মুখে এক চপেটাঘাত। প্রতিটি কোরবানি সমাজে অর্থপ্রবাহ সৃষ্টি করে। হাজার হাজার মানুষ এ সময় আয় করেন। যেমন- পশু পালনকারী, হাটকর্মী, জবাইকারী, পরিবহনকর্মী, চামড়াশিল্প শ্রমিক ইত্যাদি। কাব ইবনে মালেক (রা.) বলেন, ‘আমার একটি বকরি ছিল, যেটি আমার একজন দাসী জবাই করেছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি বিষয়টি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তা অনুমোদন করেন।’ (বোখারি : ৫৫৩৭)।

কোরবানি,সহমর্মিতা
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত