বিদ্যুতের চাহিদা ও জ্বালানি সরবরাহ বিবেচনা ছাড়াই বিগত আওয়ামী লীগ সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের পকেট ভারি করতে বহু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে পর্যাপ্ত জ্বালানি নেই। জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা কমায় দেশজুড়ে বেড়েছে লোডশেডিং, কমেছে শিল্প কারখানায় উৎপাদন।
জানা গেছে, প্রত্যেক বছরের মতো এবারও তীব্র গরমে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। এতে অন্যান্য মাসের তুলনায় মে মাসে বিদ্যুতের চাহিদা বেশি থাকছে। এই গরমে শহরে বিদ্যুৎ যাওয়া-আসার মধ্যে থাকলেও সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন গ্রাম অঞ্চলের মানুষ। গ্রাহকের চাহিদা মতো বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না পল্লী বিদ্যুৎ। আমদানি ও দেশি স্থাপিত বিদ্যুতের ক্ষমতা প্রায় ২৬ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত থাকলে ১৭ হাজার থেকে ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। কারণ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে পিক-আওয়ারে চালু রাখার জন্য, যেগুলোকে পিকিং বলা হয়। এসব কেন্দ্র একনাগাড়ে চালু রাখা যায় না। দেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে ২০২৪ সালের ৩০ এপ্রিল, এদিন ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। এই রেকর্ডও ১ ঘণ্টার উৎপাদনের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সরকারি-বেসরকারি ও দেশি-বিদেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে পাইকারি বিদ্যুৎ কিনে তা বিতরণ সংস্থাগুলোর মাধ্যমে গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহ করে। কিন্তু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চাহিদামতো বিদ্যুৎ না পাওয়ায়, ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ফলে লোডশেডিং বাড়ছে।
জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বকেয়া রাখছে, যা বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি করেছে। বকেয়া বাবদ প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা রয়ে গেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে এলএনজি আমদানিতে ২৪ হাজার কোটি টাকা চেয়ে সরকারকে চিঠি দিয়েছে পেট্রোবাংলা।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি), ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো), খুলনা ও বরিশাল বিভাগে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) ও রাজশাহী-রংপুরসহ উত্তরবঙ্গের নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই পিএলসি (নেসকো) গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। পিডিবি নিজেও চট্টগ্রামসহ কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে। পিডিবির প্রকৌশলীরা বলছেন, সারা দেশে প্রায় ৪ কোটি ৮০ লাখ বিদ্যুতের গ্রাহক আছেন। সবচেয়ে বেশি গ্রাহক আরইবির।
পিডিবির প্রকৌশলীরা বলছেন, পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় ময়মনসিংহ অঞ্চলের ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। তাদের গ্রাহক প্রায় ৫০ লাখ। গ্রীষ্মকালে এই গ্রাহকের চাহিদা দাঁড়ায় প্রায় ১৫০০ মেগাওয়াট। এই অঞ্চলে মোট ৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থাপিত ক্ষমতা ৬৪০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে দুটি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষমতা ৫৩ মেগাওয়াট, বিকালের পর এই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আসে না, পিক-আওয়ার সন্ধ্যায় এ দুটি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ বন্ধ থাকে। পিক-আওয়ার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গড়ে বিদ্যুতের প্রয়োজন ময়মনসিংহ জোনে দেড় হাজার মেগাওয়াট, এর বড় অংশ আনতে হয় ময়মনসিংহের বাইরে থেকে। কারণ বাকি পাঁচ বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ছাড়া বাকিগুলো তেলভিত্তিক। তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর খরচ অনেক বেশি হওয়ায় এই কেন্দ্রগুলো বেশি সময় চালু রাখাও যায়নি। গত বছরের এপ্রিলে এই জোনে লোডশেড ছিল প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট। এবার এই জোনে লোডশেড বেড়েছে। পিডিবির প্রকৌশলীরা উত্তরবঙ্গ নিয়েও এবার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, রংপুর জোনে ৯৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার স্থাপিত কেন্দ্র রয়েছে, যার মধ্যে আবার দুটি সৌরবিদ্যুতের ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট, যা বিকালের পর বন্ধ হয়ে যায়। ৭২০ মেগাওয়াট স্থাপিত ক্ষমতার কেন্দ্রের মধ্যে ৫২৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র, যার কয়লা আসে বড়পুকুরিয়া খনি থেকে। এই কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রে সারা বছর কোনো না কোনো সংকট লেগে থাকে, হয় কেন্দ্রের মেরামতে বন্ধ থাকে, না হয় কেন্দ্রে কয়লাসংকট। চলতি মার্চ মাসেও কেন্দ্রটির ২৫০ মেগাওয়াট সংস্কারকাজে বন্ধ রয়েছে। ফলে রংপুর জোনের স্থাপিত ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ দিয়ে এই বিভাগের জেলাগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হয়। সেখানে বাইরে থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হয়। এতে প্রয়োজনের অর্ধেক বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হয় না গ্রীষ্মকালে। গত বছরের অক্টোবরেও রংপুরসহ এই বিভাগের বিভিন্ন জেলায় তীব্র লোডশেড ছিল। এবারও সে আশঙ্কা রয়েছে। পিডিবির প্রকৌশলীরা বলছেন, এবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনাসহ বড় শহরগুলোতে লোডশেড কম রাখা হবে, তবে গ্রামে বাড়বে লোডশেড। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, লোডশেডিং যাতে না হয়, সে অনুযায়ী কাজ করছেন তারা। তবুও যান্ত্রিক ত্রুটি বা অন্য কোনো সমস্যার কারণে বাড়তি চাহিদার সময় হয়তো শোডশেডিং এক হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়ে যায়। গত বছর তীব্র দাবদাহের সময় বিদ্যুতের চাহিদা ১৮ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছে গিয়েছিল। অনেক সময় যান্ত্রিক সমস্যা, সঞ্চালন লাইনের দুর্বলতা থাকায় এখন কিছু লোডশেডিং হয়তো হতে পারে। আমাদের চেষ্টা থাকবে লোডশেডিং মুক্তভাবে এবারের গরমের মৌসুম পার করা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, দেশীয় গ্যাসের সংস্থান না করতে পারলে দেশকে লোডশেডিং মুক্ত করা যাবে না। বিদেশ থেকে কয়লা ও গ্যাস কিনে এনে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বিদ্যুৎব্যবস্থাকে লোডশেডমুক্ত রাখা সম্ভব নয়; কারণ, সে সক্ষমতা আমাদের নেই।